জিজ্ঞাসু:—আপনার লেখা ‘সহজতা ও প্রেম’ বইটা অনেকের কাছেই সমাদৃত হোচ্ছে—চরৈবেতি কার্যালয়ে অনেকে চিঠি লেখে এই বিষয়ে। একজন লিখেছে যে, _”বারবার বইটা পড়লেও পুনরায় পড়ার সময় যেন মনে হয় আবার নতুন কোনো শিক্ষা পাওয়া যাচ্ছে”।

গুরুমহারাজ:—হ্যাঁ, ‘সহজতা ও প্রেম’ এবং ব‌ইটির ইংরাজী অনুবাদ ‘Naturality And Love’ পড়ে অনেকেই উপকৃত হয়েছে। আমিও রাস্তাঘাটে বা বিভিন্ন স্থানে ঘোরার সময় অনেককে দেখেছি বইটিকে মনোযোগ সহকারে পড়তে ! অনেককে এই ব‌ই-এ উল্লেখিত বিভিন্ন tropic নিয়ে আলোচনা করতেও শুনেছি! একবার Europe যাবার সময় দমদম বিমানবন্দর থেকে Plane টা ছাড়ার পরই দেখি একজন জার্মানী ভদ্রলোক বইটার ইংরাজী অনুবাদ(‘Naturality And Love’)-টি পড়ছে। ট্রেনে আজিমগঞ্জ যাবার সময় কাটোয়া লোকালে একজনকে বইটা পড়তে দেখেছিলাম। বর্ধমান থেকে বাসে করে বনগ্রাম ফেরার সময় নবস্থা(বর্ধমান থেকে জাবুইডাঙা আসার পথে একটা বাস-স্টপেজ)ওখানে এক ভদ্রলোক আমার সাথে যেচে আলাপ করলো, তারপর বনগ্রাম মিশনে থাকি(গুরুজী নিজের পরিচয় দেন নি)শুনে ‘সহজতা ও প্রেম’ বইটির উল্লেখ করে বললো, ‘ঐ বইটি দারুণ ! ঐ লেখকের অন্যান্য বই বেরুলে, সম্পাদককে বলবেন খবর দিতে! আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।’

দ্যাখো, আশ্রমে আসার অনেক আগে থেকেই আমার এই ধরণের ছোটো ছোটো পুস্তকের সাহায্যে অধ্যাত্ম জগতের প্রকৃত বিষয়বস্তুগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরার ইচ্ছা ছিল। তাছাড়া গুরু বাউলানন্দের নির্দেশও ছিল এইরূপ। তাই এই ধরণের ছোটো বই লেখা হয়েছে !

মোটা বই-এ নানান কথার অবতারণা করা হয় এবং সেগুলির ব্যাখ্যাও থাকে—এতে মানুষের খুবই অসুবিধা হয়। মূল বিষয়বস্তু থেকে পাঠকের মন স্থানান্তরিত হয়ে যায়, ফলে বিষয়বস্তুর সারমর্ম বোঝা সহজ হয় না। কোনো আধ্যাত্মিক পুস্তক তো আর উপন্যাস নয় যে তাতে শুধু মানুষের জীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের কথা লেখা থাকবে। ওইসব লঘু ধরণের পুস্তকগুলি মানুষের জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে মিল থাকায় ওইসব মনে রাখতে মানুষের কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু আধ্যাত্মিক তত্ত্বসম্বলিত পুস্তক সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়ের উপর লেখা—যেগুলোর সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের কোন ধারণাই নাই ! সেখানে কাউকে ঢোকাতে হোলে তোমাকে বিষয়বস্তুকে to the point রাখতে হবে এবং যতটা সম্ভব ছোটো করতে হবে। ‘সহজতা ও প্রেম’ বইটি এইসব চিন্তা করেই লেখা।

এই ব‌ইটির প্রতিটি পরিচ্ছেদ যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। সবটা একসঙ্গে পড়তেই হবে, তার কোনো দরকার নাই, একটা পরিচ্ছেদ শেষ করলেই একটা বিশেষ ব্যাপারের জ্ঞানলাভ করা সম্ভব হবে। দেখবে আশ্রম থেকে পরে পরে(তখন ১৯৯০-৯১ সাল)এই ধরণের আরও অনেক বই বের হবে।

জিজ্ঞাসু:—ষড়ৈশ্বর্য কি—যদি একটু ব্যাখ্যা করেন ?

গুরুমহারাজ:—যশ, শ্রী, বল, জ্ঞান, ঐশ্বর্য ও বৈরাগ্য—এই ছয়টিকে ঈশ্বরের গুণ বা ঐশ্বর্য বলা হয়। যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে এই ছয়টি ঐশ্বর্যর প্রকাশ দেখা যায় তাহলে জানবে তিনিই মর্তধামের মূর্তিমান ভগবান! সেই অমূর্ত ঈশ্বরতত্ত্বই মূর্তিমান হয়েছেন, সেই পূর্ণই সীমায়িত হয়েছেন কোনো নরশরীরে লীলা আস্বাদন করার জন্য।

প্রত্যেকটি ঐশ্বর্য বা গুণের আবার আধিভৌতিক, আধিদৈবিক এবং আধ্যাত্মিক এই ত্রিবিধ প্রকাশ রয়েছে। যেমন ১) যশ—ভূঃ, ভূবঃ, স্বঃ—এই ত্রিলোক তাঁর যশোগানে মুখরিত —এটাই ভগবানের যশোরূপ ঐশ্বর্য। ২) শ্রী—ভগবানের দেহ শ্রীমণ্ডিত হবে, তাঁর কর্ম শ্রীমণ্ডিত হবে এবং তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনও শ্রীযুক্ত হবে অর্থাৎ স্বয়ং লক্ষ্মীরূপিণী শক্তি স্থূলে তাঁর পাশে পাশে থাকবে। ৩) বল—তাঁর লোকবল, যোগবল এবং আধ্যাত্মিক বল—এই ত্রিবিধভাবেই বল বা সামর্থ্যের প্রকাশ থাকবে। ৪) জ্ঞান— জগৎ, জীবন এবং ঈশ্বর—এই ত্রিবিধ জ্ঞান অর্থাৎ পরা ও অপরা জ্ঞানের যাবতীয় বিষয় তাঁর আয়ত্তে থাকবে। তাই যে কোনো জিজ্ঞাসার উত্তর তিনি তৎক্ষণাৎ প্রদান করতে সমর্থ। ৫) ঐশ্বর্য —তাঁর জীবনে লৌকিক বা জাগতিক ঐশ্বর্য, যোগৈশ্বর্য, এবং আধ্যাত্মিক বা পারমার্থিক ঐশ্বর্যের প্রকাশ থাকবে। ৬) বৈরাগ্য—তাঁর জীবনে সাংসারিক বা সামাজিক বৈরাগ্য তো থাকবেই, তাছাড়াও তিনি কর্মে বৈরাগী হবেন অর্থাৎ তাঁর দ্বারা শুধু নিষ্কামকর্মই হয়ে যাবে—অন্য কিছু নয়। এছাড়া তাঁর সুকর্মজনিত কীর্তির প্রতিও তাঁর বৈরাগ্য পরিলক্ষিত হবে। সাধারণত লক্ষ্মী এবং সরস্বতী তাঁর দু’পাশে বিরাজমানা থাকেন তবু তিনি কোনোটাতেই আসক্ত বা আবদ্ধ হ”ন না ।

তাহলে দেখা যায় ৬টি ঐশ্বর্যের ত্রিবিধ প্রকাশের মোট ৩× ৬=১৮টি বিশেষ গুণ ভগবানকে ঘিরে প্রকাশিত হয়। গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়, মহাভারতের অষ্টাদশ পর্ব, অষ্টাদশবিধ সংস্কার ইত্যাদি বিভিন্নভাবে শাস্ত্র যে ‘১৮’ সংখ্যাটির উপর জোর দিয়েছে, তার উৎস ভগবানের এই “ষোলোর উপর আঠারো কলা” প্রকাশের নিমিত্তই।।