গুরুমহারাজ: — এটা ঠিক বলেছো, আমি আর পাঁচজনের মতো নই, আমি আমার মতো। আর এই জন্যই ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন মঠ-মিশনের অধ্যক্ষ-মন্ডলেশ্বরদের সঙ্গে আমার বিরোধ হোতো। তারা সকলেই আমাকে বিভিন্ন আচারে বা নিয়মের অনুশাসনে বাঁধতে চায়। কিন্তু আমি বদ্ধ হবো কেন ? আমি তো জানি যে—আমি নিত্য-মুক্ত, তাই আমি সকলকে মুক্ত হবার কথা বলি, মুক্তির পথ দেখাই! ফলে আমি নিজে কি করে কোনো বাঁধনে জড়াবো ! আমাদের এই আশ্রমে অর্থাৎ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনেও যেহেতু অনেক লোকজন, অনেক আবাসিক ছেলে__তাই অনেক সময় নানান অসুবিধা ঘটে যায়, তখন সবাই বলে—’আশ্রমে নিয়ম লাগু করুন, আশ্রমিকদের অনুশাসনে বাঁধুন’। কিন্তু আমি তো তা পারি না ! আমি সকলকে বলে দিয়েছি যে, আমি থাকতে আশ্রমে কোনো বিভাগেই কোনো বাঁধাধরা আইন বা নিয়ম থাকবে না। শুধু একটাই অনুশাসন থাকবে সেটা বিবেকের অনুশাসন।।
আমি যখন থাকবো না তখন আশ্রমে আইন হবে—নিয়ম হবে, অনুশাসনের নিগঢ়ে বাঁধার চেষ্টা হবে। প্রথম প্রথম আমি ব্রহ্মচারীদের ভোরবেলায় উঠিয়ে দিয়ে আমার ঘরে বসিয়ে ধ্যান- জপ করাতাম কিন্তু দেখা গেল তাদের অনেকেরই এটা করতে কষ্ট হোচ্ছে, তাই কিছুদিন পর সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হোলো। এখানে বিবেকের প্রহরায় সকলকে ছেড়ে রাখা আছে, ঠিক ঠিক follow করলে অগ্রগতি হবেই–তাকে কেউ আটকাতে পারবে না !
যাইহোক যা বলছিলাম, এই তো কিছুদিন আগেই ঋষিকেশের কৈলাস আশ্রমের প্রেসিডেন্ট স্বামী বিদ্যানন্দ গিরির সাথে আমার বিরোধ হয়ে গেল ! একে তো উনি সন্ন্যাসী, তায় আবার শাস্ত্রী—অর্থাৎ উনি একজন বিরাট পণ্ডিত ! যে কোনো সভায় আমন্ত্রিত হোলে উনি stage-এ উঠে বিশুদ্ধ সংস্কৃতে ভাষণ দেন। তাছাড়া এই ধরণের নানান গুণসম্পন্ন বলেই শুধু নয়, যেহেতু উনি কৈলাস আশ্রমের অধ্যক্ষ__ তাই উত্তর ভারতের সাধুসমাজে তাঁর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। জানো তো _আমারও সন্ন্যাস সংস্কারের কাজটা উনিই করেছিলেন ।
পরবর্তীকালে আমি, আমার স্ব-ভাব ও সংস্কার অনুযায়ী এখানকার মিশনের কাজের সুবিধার স্বার্থে কয়েকজন ত্যাগী ছেলেদের সাথে সাথে কয়েকজন ত্যাগব্রতী মেয়েদেরও ব্রহ্মচর্য বা সন্ন্যাস দিয়েছিলাম। সেবার তপি মা (পবিত্র প্রাণা ) আমার সাথে হিমালয়ের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরছিল । ঘুরতে ঘুরতে আমরা উত্তরকাশীতে এসে গুরুদেব রামানন্দজীর আশ্রমে বেশ কয়েকদিন ছিলাম। উত্তরকাশীতেই কৈলাস আশ্রমের শাখা রয়েছে, সেখানে বিদ্যানন্দজীর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। উনি মেয়েদের সন্ন্যাস দেওয়া নিয়ে আমার কাজের বিরোধ করলেন। বললেন_ ‘যেহেতু তুমি গিরি সম্প্রদায় থেকে সন্ন্যাস নিয়েছো, তাই সেই সম্প্রদায় এবং তার সমস্ত নিয়ম তো তোমাকে মানতে হবে’! উনি খুব গলা চড়িয়ে কথাগুলো আমাকে বললেন ! তখন আমি ওনার চেয়েও গলা চড়িয়ে উত্তর দিলাম, “হাঁ, জরুর হম্ আপ কা পাশ হি সন্ন্যাস সংস্কার কিয়া হ্যায়, লেকিন ইয়ে ভি আপ মান লো কি ম্যায় কোই সম্প্রদায় কা গুলাম নহি হুঁ” !! আসলে কোনো কিছুর দোহাই দিয়ে নিজেকে আটকে রাখা আমার প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। যা আমাকে হীনবল করে আমি তা মানি না! আমি কখনই হীনমন্যতায় ভুগি না। নারী ব’লে সন্ন্যাসের অধিকারিণী নয়—এই হীনভাব ভালো নয়, বরং অপরকে হীন ভাবাটাই অপরাধ বলে আমি মনে করি। গিরি সম্প্রদায়রা হয়তো নারীকে সন্ন্যাস দেয় না—এই নিয়ে বহুপূর্বে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গেও এদের বিরোধ হয়েছিল।
যাইহোক কোনো সম্প্রদায়ের যদি এই বিধান হয়, তো_ আমি সেই সম্প্রদায়কেও মানি না আর তার বিধানও মানি না। আমার গুরুদেব রামানন্দজী যদি নিষেধ করতেন _তাহলে সেটা ছিল অন্য কথা। কিন্তু তিনিও ঐসব সম্প্রদায়ের নিয়ম মানতেন না। তাঁর এই উদারনৈতিক মনোভাবের জন্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত সাধুরা তাঁকে এড়িয়ে চলতো। তবে তিনি বেদান্তকেশরী, অবধূত ছিলেন বলে শ্রদ্ধায় এবং ভয়ে সবাই তাঁকে ভক্তি বা মান্য করত । তিনি কিন্তু কাউকেই পরোয়া করতেন না। শুধু বৎসরে একবার উত্তরকাশীতে এবং আর একবার গঙ্গোত্রীতে সাধুদেরকে নিমন্ত্রণ করে ‘ভাণ্ডারা’ দিতেন।
যাইহোক যা বলছিলাম, প্রতিটি মানুষ তার নিজ নিজ প্রকৃতি বা স্বভাব অনুযায়ী চলে । আমিও আমার প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কোনকিছু দেখলে তার প্রতিবাদ করি, সময় সময় বিরোধও হয়। ছোটবেলায় ঘোরার সময় কত সাধু- সম্মেলন, জমায়েত, ফাতা-নাতা করে বিরোধ লাগিয়ে ভেঙে দিয়েছি—তার কি কোনো হিসাব আছে !