জিজ্ঞাসু:—হিন্দুদের নানান দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে_যেগুলিকে তারা মানে বা পূজা-অর্চনা করে। আবার এমন লোক‌ও বহু আছে _যারা দেব-দেবী মানে না। এখন আমার জিজ্ঞাসা হোলো __এই দেব-দেবীগুলি মানা বা না মানার ফল কি ?

গুরুমহারাজ:— দ্যাখ্ __কোনো দেবতা অথবা কোনো দেবীকে মানা বা না মানায় কিছু আসে যায় না ! যদি পারিস তো তাঁদেরকে জানার চেষ্টা কর্ , সেই দেবতা বা দেবীর তত্ত্ব জানার চেষ্টা কর্। তবে তোকে ব্যক্তিগতভাবে আমি বলবো–জগতের আরো অনেক কিছুই যখন মানছিস, তখন এটাই বা না মানার কি আছে ? আজকাল দেখছি, শিক্ষিত ইয়ং ছেলেমেয়েদের ভারতীয় দেব- দেবীদেরকে না মানাটা যেন একটা fashion হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতদিন নিচের ক্লাসের দিকে পড়াশুনা করে, ততদিন অধিকাংশরাই মা সরস্বতীকে একটু-আধটু মানে, তারপরে আবার তাও মানে না।

সে যাইহোক, তোকে বলছিলাম না যে __দেব-দেবীদেরকে মানা বা না মানায় কিছু যায় আসে না ! দেখবি– সমাজ‌ও এই নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না, কারণ এতে সমাজের সার্বিকভাবে তেমন কোনো অনিষ্ট হয় না। কিন্তু ঐ ধরণের ঈশ্বর না মানা ব্যক্তিরা যদি অসৎ, দুরাচারী, অসংযমী বা উচ্ছৃঙ্খল হয়– তাহলেই সমাজের ক্ষতি।
সেইজন্য দেব-দেবীকে মানে না, ঈশ্বরকে মানে না _অথচ কোনো সৎ-বিবেকবান ব্যক্তি যদি কোথাও থাকে, তাহলে জানবি সেই ব্যক্তি যথার্থ ধার্মিক। কিন্তু দেব-দেবীর ঘটা করে পুজো করছে অথচ ব্যক্তিটি অসৎ, উচ্ছৃঙ্খল, কপট _ এরাই তো সমাজের আবর্জনা ! আর এই সমস্ত আবর্জনা সমাজে থেকে যাওয়া মানেই জানবি _তারা সমাজকে দ্রুত কলুষিত করে তুলবে !

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় সেইরকমভাবে অর্থাৎ প্রচলিত পদ্ধতিতে দেব-দেবী মানতেন না কিন্তু তিনি ছিলেন প্রকৃত বিদ্বান ব্যক্তি এবং ছিলেন দয়ার সাগর ! তাই সমকালীন মানুষের কাছে তিনি নিজেই ‘দেবতা’ হয়ে উঠলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে প্রথম দেখেই বলেছিলেন_ “একে দেখে তো বাসুদেব সার্বভৌম মনে হোচ্ছে”।

তাই বলছিলাম__ মানা বা না মানায় কোনো কিছু যায় আসে না, প্রকৃত “তত্ত্ব” জানাটাই আসল। তবে, একটা কথা কি জানিস –ধরে নে, তোর বাড়ীতে বা বাড়ীর কাছাকাছি অথবা গ্রামে কোনো দেব-দেবীর মন্দির বা মূর্তি যেখানে রয়েছে, যেখানে বহুলোক, বহুকাল থেকে পুজো দিচ্ছে—ভক্তি নিবেদন করছে ! অথচ ধরে নে –তুই সেটা অবজ্ঞা বা অগ্রাহ্য করছিস, তা হোলে কিন্তু তুই নানাবিধ আধিদৈবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বি। কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের আধিদৈবিক বিপর্যয় (শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অশান্তি )-এর মূল কারণ হোলো দৈব রুষ্ট হওয়া !

এক্ষেত্রে কোনো কারণে দৈবকে অগ্রাহ্য বা অবমাননা করা হয়েছে—এটা নিশ্চিত এবং এটা হোতেই হবে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে দু-চারটি এরকম পরিবারের উদাহরণ খুঁজে নিয়ে অনুসন্ধান কর্, দেখবি ঠিক সঠিক কারণ পেয়ে যাবি এবং তখনই বুঝতে পারবি, আমি যা বললাম তা সত্য __কিনা ?

জিজ্ঞাসু:—এছাড়াও ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এই তিন মূর্তির একটা তাত্ত্বিক দিকও তো আছে ?

গুরুমহারাজ—আছে বই কি ! ব্ৰহ্মা Theory of projection, বিষ্ণু Theory of sustaintion, মহেশ্বর Theory of destruction | তাই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এগুলো নিছক মূর্তিকল্পনা নয়। এগুলি সবই এক একটা Great Principle। পৃথিবীগ্রহে কোটি কোটি বছর আগে যেহেতু জলে প্রথম ক্লোরোফিলযুক্ত কোনো প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল __ তাই জলকে বলা হয়— “আপঃ নারায়ণঃ”। এইভাবে ৫০০ কোটি বছর আগে জড় থেকে প্রাণের উৎক্রমণের বা জীবনের অগ্রগতি শুরু। এবার জড়কে ভাঙলে অণু- পরমাণু পাওয়া যাচ্ছে। পরমাণুকে ভাঙলে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনজাতীয় আরও অনেক কণিকা পাওয়া যাচ্ছে, যাদের ইংরাজীতে বলা হচ্ছে particle। এই particle- দের নিয়েই Particle dynamics নামে জড়বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত খুলে গেছে এখন।

যাইহোক, বর্তমানে পরমাণুকে explosion করা হোচ্ছে অর্থাৎ neuclear explosion । ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম অর্থাৎ ভারী ধাতুর পরমাণুকে explosion করলে chain reaction-এ তা ৩৩ বার বিস্ফোরিত হয়, ফলে যে সব মূল কণিকা নিয়ে কোনো পরমাণু গঠিত হয়, এই বিস্ফোরণের ফলে তাদের কোন অস্তিত্বই থাকছে না—সেগুলি বিশ্লেষিত হয়ে আরও নতুন নতুন কণিকার রূপ নিচ্ছে, যাদের নাম দেওয়া হয়েছে মেগাটন, সাইট্রোপ্রোটন ইত্যাদি। যাদের Life-period বা স্থায়িত্বকাল মাত্র কয়েক Micro-second, তারপরই এরা আবার অন্য কোনো কণিকায় রূপ নিয়ে নিচ্ছে।

তাহলে অতিক্ষুদ্র পরমাণুকে নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা যে রহস্য অবগত হোচ্ছেন— গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিরাটরূপেও সেই একই তত্ত্ব বিরাজমান। এখানে সবকিছুরই সৃষ্টি আছে, তার কিছুকাল স্থায়িত্ব রয়েছে এবং তার বিনাশ রয়েছে। এই বিনাশ আবার নতুন কিছু সৃষ্টির বীজ। এইভাবেই জড়, জীবন, জগৎ একই Principle-এ বিধৃত রয়েছে। এই তত্ত্বই Theory of projection, Theory of sustaintion এবং Theory of destruction বা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল মানুষের কাছে। ঋষিরা চিন্তা করেছিলেন যে, যে কোনো তত্ত্ব গল্পের আকারে পরিবেশিত হলে মানুষ যত তাড়াতাড়ি তা গ্রহণ করবে অন্য কোনভাবে তা সম্ভব নয়। এইভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন পুরাণের, যেগুলির মধ্যে বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণার তত্ত্ব গল্পাকারে লুকিয়ে আছে। শাস্ত্রে বলেছে, “সমস্তম কল্পনামাত্রম্ আত্মামুক্তসনাতনম্”। এই তত্ত্বও আজকে স্বীকৃত হয়েছে, কারণ ঐ যে বললাম—যে কোনো মূল কণিকা ভেঙে যে সমস্ত কণিকা তৈরী হোচ্ছে তাদের স্থায়িত্বকাল মাত্র কয়েক Micro-Second ! তারপরেই তারা আবার অন্য কোনো particle-এ রূপ নিচ্ছে। তাহলে জড়ের উৎস খুঁজতে গেলে কোনো নিত্য বা শাশ্বত কোনো particle-কে পাওয়া যাচ্ছে কি ? না, পাওয়া যাচ্ছে না, তাই বলা হয়েছে—‘সমস্তম্ কল্পনামাত্রম্’। তাহলে এখানে বস্তু নিত্য নয়, শক্তিও নিত্য নয়—যা নিত্য তাকে ‘ব্রহ্ম’ এই শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়েছে। সেখানে কিন্তু দ্যাখো,__ ব্রহ্মের কোনো আকার বা মূর্তির কল্পনা করা হয় নি। ‘অবাঙমনসগোচরঃ’, অজ, শাশ্বত, নিত্য ইত্যাদি শব্দ দিয়ে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এইসব থেকে প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের চিন্তার গভীরতা যে কত ছিল তা আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তত্ত্ব বা গবেষণা থেকে অনেকটাই জানা যায়। স্বামী বিবেকানন্দ বোধহয় এইজন্যই বলেছিলেন—আধুনিক বিজ্ঞান যত উন্নত হবে—ভারতীয় ধর্ম- শাস্ত্রগুলির মর্মার্থ তত ভাল করে বোঝা যাবে।।