গুরুমহারাজ:—দ্যাখো, ঈশ্বরের অবতরণ হয় শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয় —তাঁর আগমনের অন্যতম উদ্দেশ্য হোলো বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা। প্রকৃতি এবং সমাজকে disharmony থেকে harmony-তে নিয়ে আসা, অসহজতা থেকে সহজতায় নিয়ে আসা—এটাই উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বপ্রকৃতি যে সৃষ্টি হয়েছে এবং এই সৃষ্টির ধারা অনাদিকাল থেকে continue হয়ে চলেছে –এই সবকিছুর মূলাধারটিকে ধরতে হবে। একে অগ্রাহ্য করলে কোনো কিছু স্থায়ী হবে না- সব বিকৃত হয়ে যাবে, অসহজ হয়ে যাবে !
অলৌকিক শক্তি থাক বা না থাক যে সাধক, প্রকৃতির এই মূল সুরটির অনুকূলে আছেন_ তাঁর কখনও পতন হয় না। রাগ-রাগিণীর বিস্তার যতই করা হোক না কেন, সংগীতের মধ্যে কালোয়াতি যতই ঢোকানো হোক না কেন__ বাদী-সুরটিকে সর্বদা ঠিক রাখতে পারেন যিনি, তিনিই ওস্তাদ গায়ক।
কাশীতে আমি একবার পণ্ডিত ওঁকারনাথের এক সংগীতানুষ্ঠানে ওনার গাওয়া ‘মালকোশ’ রাগ শুনেছিলাম। এখনকার মধ্যে ভীমসেন যোশীও উন্নত গায়ক কিন্তু ওঁকারনাথজী যেন সংগীতে সিদ্ধ। আমি প্রকৃতির সুরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছিলাম যে, ওনার গানের মধ্যে বিভিন্ন সুরের ব্যঞ্জনা চলছে ঠিকই কিন্তু মূল বাদী সুরটি সবসময় অক্ষুণ্ণ রয়েছে। পূর্ব পূর্ব কালে জয়দেব, তানসেন এঁরা সব সংগীতে সিদ্ধ ছিলেন, এঁরা মেঘমল্লার রাগ গাইলে নাকি আকাশে মেঘের সঞ্চার হোতো বা বৃষ্টিপাতও হোতো।
যাইহোক আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যে কোনো সাধনার শীর্ষে বা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে গেলে চাই ঐকান্তিক নিষ্ঠা। অভীষ্ট লক্ষ্য হোলো ঈশ্বরত্বলাভ বা জীবের শিব হওয়া অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন। ভারতীয় যোগমার্গের ৪টি ধারা আছে—ব্রহ্মা ধারা, বিষ্ণু ধারা, মহেশ্বর ধারা এবং শক্তিধারা। এই ধারাগুলির যে কোনো একটিকে অবলম্বন করতে হয় এবং তারপরে আবার ঐ ধারা ধরে দু’ভাবে এগোনো যায়__ নেতি-নেতি আর ইতি-ইতি। ‘বাসুদেবম্ সর্বমিতি’ —সবকিছুই তিনি। তাই পাওয়ার art জানা থাকলে, সবকিছুতেই তাঁর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়! কিন্তু মানুষ পাওয়ার বা চাওয়ার কৌশলটাও জানে না। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে, আধার ভেদে শক্তির তারতম্য হয়–প্রকাশের তারতম্য হয়। ফলে কৃপাময়ী বা করুণাময়ী তাঁর কোনো সন্তানকেই তাঁর capacity-র চাইতে অধিক __এইরূপ শক্তি সাধারণত দিতে চান না, কারণ দিলেই সেই শক্তির অপব্যবহার হবে এবং ঐ সাধকের চরম ক্ষতিসাধন হবে।
এমনিতে দেখা যায় তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির প্রাণ বাঁচাতে পারে জল, কিন্তু প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিকে যদি জলে ডুবিয়ে ধরা হয় তাহলে সে তৎক্ষণাৎ মারা যাবে অথবা প্রচণ্ড শীতার্ত ব্যক্তির প্রয়োজন উত্তাপ কিন্তু তাকে যদি আগুনে ফেলে দেওয়া হয় সে দগ্ধ হয়ে মারা যাবে। এইভাবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কিছুই মঙ্গলদায়ক নয়। ঈশ্বর মানুষসহ সমস্ত জীবজগৎ বা জড়জগৎকে, যাকে যেটুকু দেবার দরকার তাকে সেইটুকু দিয়ে রেখেছেন। প্রতিটি individual যদি সেটা বুঝে অপরের প্রতি ঈর্ষা বা হিংসা না করে নিজের নিজের শক্তি নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় ঈশ্বর-প্রীতির জন্য কাজে লেগে যায়—তাহলে এর থেকে বড় আধ্যাত্মিকতা আর কি আছে! কিন্তু তা না করে শক্তির অপব্যবহার করলেই অধঃপতন হয়।
মনুষ্যসমাজে সাধকরূপ প্রচুর unit রয়েছে, যদি একটি একটি করে unit এইভাবে অধঃপতিত হোতে থাকে, তাহলে সমাজ হয়ে যায় disharmonised। সমাজের মানুষ মূলসুরকে ছেড়ে তখন বিভিন্ন রাগ- রগিণীর বিস্তারে মত্ত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় মানুষকে পুনরায় মূলসুরে ফিরিয়ে আনার জন্য, সমাজের disharmony-কে harmonise করতে হয়। আর তা করার জন্য-ই আগমন হয় অবতার পুরুষের এবং প্রয়োজন হয় বিভিন্ন মহাপুরুষের জন্মগ্রহণ করার। এগুলি সবই Divine Plan !!! তোমার আমার ইচ্ছায় এসব কিছুই হয় না।
তবে তুমি যে ‘অলৌকিক’ শব্দটা প্রয়োগ করছিলে এটা ঠিক নয়। অলৌকিক বলে পৃথক কিছু নেই, ওটা হয় ভাঁওতা অথবা বিজ্ঞান। উন্নত যোগীরা সূর্যবিজ্ঞান, চন্দ্রবিজ্ঞান ইত্যাদি জানেন, ফলে এইসব বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা এমন অনেক জিনিস করতে পারেন, যা সাধারণ লোকে করতে পারে না অর্থাৎ লৌকিক নয়। তাই সেগুলিকে অলৌকিক বলা হয়। সূর্যবিজ্ঞানকে কিভাবে কাজে লাগানো হয় তা বলছি—আলোর মাধ্যে যে ফোটনকণা আছে সেটা নিস্তড়িৎ। ফলে এটা যে কোনো charge-এ যুক্ত করা যায়। এইবার বায়ুমণ্ডলেই তো বিভিন্ন element রয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে এই charged praticle-এর সং- যুক্তি ঘটিয়ে material change করা যায়। বিভিন্ন যোগীরা এটাই করে থাকেন, তবে ষড়ৈশ্বর্যবান ভগবান যখন যেখানে অবতীর্ণ হ’ন, তখন তাঁকে আর আলাদা করে কোন miracle বা ঐ জাতীয় কিছু দেখাতে হয়। না। তাঁর চারিপাশে বা তাঁকে কেন্দ্র করে এমনিতেই এমন অনেক জিনিস ঘটতে থাকে যা লৌকিক নয়। বিভিন্ন ঐশ্বর্যের প্রকাশ ঘটতে থাকায় এইরকমটা হয় ফলে স্থানীয় সাধারণ মানুষের মধ্যেও ঐ ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে একটা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। অর্থাৎ জ্ঞানী, যোগী, সাধক বা ভক্তরা তাঁকে চিনতে পারে বা তাঁর লক্ষণ মিলিয়ে তাঁর কাছে আসেন কিন্তু সাধারণ মানুষ হয়তো সেসব কিছু বোঝে না, তবুও কোন না কোন ভাবে তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়। এইভাবেই কোন মহাপুরুষের চতুঃপার্শ্বস্থ প্রভাবও কোন মহাপুরুষকে recognise করার একটা উপায় ।