গুরুমহারাজ :—-অতিরিক্ত আনন্দে আমার এমনটা হয় ! আলোচনা করার সময় কোনো আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গ যেই একটি নির্দিষ্ট উচ্চতাযুক্ত স্তরে এসে পৌঁছায় বা জিজ্ঞাসাকারী যদি কোনো উচ্চতত্ত্ব সম্বন্ধে ধারণা নিয়ে জিজ্ঞাসা করে বসে – তখন সেই সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হোতেই আমার মস্তিষ্ক থেকে একপ্রকার অমৃতরস নিঃসৃত হয়, যা মস্তিষ্কের আভ্যন্তরীন কোষগুলিকে আচ্ছন্ন করে আমার বাকশক্তিকে রুদ্ধ করে দেয়। এ এক পারমার্থিক রমণের অবস্থা !! সাধারণ রমণেই দেখা যায় শরীরের অন্যান্য অঙ্গ ক্রিয়াশীল থাকলেও বাকশক্তি মুহূর্তের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়—এক্ষেত্রে সেই রমণের চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ বেশী আনন্দ !! সুতরাং সেই সময় স্বাভাবিক ভাবেই আমার কথা বন্ধ হয়ে যায় ! যার এইরূপ অবস্থা হয়_সে জানে যে, সেই সময় শুধু এক অব্যক্ত আনন্দের আস্বাদন ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি থাকে না। তবে ঐ অবস্থায় আমি দেখেছি যে, আমার শরীর থেকে আনন্দের তরঙ্গ চতুর্দিকে প্রবাহিত হোতে থাকে, যদি আমার কাছাকাছি কোনো আধ্যাত্মিক ব্যক্তি উপস্থিত থাকেন তাহলে তিনি এটা অনুভব করতে পারবেন। হয়তো তাঁর শরীরে কম্পন, পুলক ইত্যাদির লক্ষণ দেখা দেবে।
যাইহোক, এই সময় আমার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ কিন্তু ক্রিয়াশীল থাকে এবং আমার চেতনা বিলুপ্ত হয় না। তাই ঐ অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হবার জন্য আমি কোনো পার্থিব জিনিস গ্রহণ করি। দেখবে, ঐ সময় আমি হয়তো পকেট হাতড়ে সিগারেট ধরাই কিংবা কাউকে ইঙ্গিতে জল বা চা দিতে বলি। এগুলো গ্রহণ করলেই মন আবার হু হু করে নীচে নেমে আসে এবং আবার আমি আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতে পারি। এরকমই কোনো সময় হয়তো তুমি আমাকে দেখেছো।
জিজ্ঞাসু—আপনার ঐ অবস্থার আনন্দ -তরঙ্গ ‘আমরা'(সাধারণ মানুষেরা) অনুভব করতে পারি না কেন ?
গুরুমহারাজ—তোমাদের নিজ নিজ আধারকে উন্নত করতে পারোনি বলে ! স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন — ‘সাধারণ মানুষ মল-মূত্রের বেগ ধারণ করতে পারে না তো আধ্যাত্মিক বেগ ধারণ করবে কি করে ?’ যে আধার(শরীর) পারমার্থিক সত্তার প্রকাশে সক্ষম, সেই শরীর পারে। আর সেইরূপ আধার তৈরী করার জন্যই তো সাধনার দরকার হয় ! অন্যথায় সাধনার কি প্রয়োজন ? কিন্তু সাধনা করার জন্য সচেষ্ট না হয়ে মানুষ তার আধারটিকে কি অন্যায়ভাবেই না ব্যবহার করে থাকে_বলোতো !! দেহ এবং অন্তঃকরণবিশিষ্ঠ শরীরকেই তো ‘মন্দির’ বলা হয়েছে। দ্যআখও, কোনো মন্দির যদি পবিত্র না থাকে– নোংরা পাপনিবাস হয়, তাহলে কি লোকে সেই দেবালয়কে ভক্তি করে_ না সেখানে দেবতার অধিষ্ঠান হয় ? সেইরূপ দেহ-মন্দির হোলো অন্তরাত্মার আধার ! প্রত্যেক জীবের মধ্যে যে শিবত্ব রয়েছে __তার প্রকাশ ঘটে পবিত্র-হৃদয়ে, পবিত্র দেহ-মন্দিরে। যে ব্যক্তি যত পবিত্র– তার মধ্যে পরমেশ্বরের তত প্রকাশ!! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ময়লা কাঁচ দিয়ে সূর্যকেও দেখা যায় না, কাঁচ যত পরিষ্কার হবে সূর্য ততই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতররূপে দেখা যাবে। তাই যে কোনো সাধককে সর্বপ্রথমে মনের ময়লা পরিষ্কারের কাজে ব্রতী হোতে হবে। মন নির্মল হোলেই দেহ-রূপ আধারও নির্মল হবে, আর নির্মল আধারে পরমেশ্বরের লীলারসের আস্বাদন হবে।
তবে এটা অবশ্য ঠিক—কোনো মহাপুরুষ ইচ্ছামাত্র যে কাউকে(তা সে যতোই আধ্যাত্মিকভাবে অনুন্নত হোক না কেন) ক্ষণিকের জন্য এই রস-আস্বাদন করাতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই তা ক্ষণিকের জন্য ! কারণ অনুপযুক্ত আধার ঐ প্রচণ্ড বেগ ধারণ করতে পারে না, অধিকক্ষণ ঐ অবস্থায় থাকলে তার শরীরপাত হয়ে যেতে পারে অথবা ব্যক্তিটি পাগল হয়ে যেতে পারে !
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের একটি কথা আছে—’কুঁড়ে ঘরে হাতি ঢোকা’ অর্থাৎ পাগলা হাতি কুঁড়ে ঘরে ঢুকলে যেমন ঘরটির তছনছ অবস্থা হয়, এখানেও সেইরূপ !
আমাদের সব্য(হুগলীর সিঙ্গুর এলাকার একজন ভক্ত) হিমাচল প্রদেশে আমায় একবার খুব করে ধরেছিল_spiritual touch দেবার জন্য ! আমি জানি এইটা গুরু পরম্পরার নির্দিষ্ট পদ্ধতি নয় ! কিন্তু বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও যখন ও শুনলো না__ তখন ওকে touch দেওয়া হয়েছিল। তারপর ওর শরীরের কি অবস্থা ! শরীর পাত হয়ে যাবার যোগাড় !! পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসার পর সব্য আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল – ‘ এমনটা কেন হোলো ?’ আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘ তোমার আধার অপ্রস্তুত ! তাই অমনটা হোলো !’
তাহলে বোঝা যাচ্ছে – উন্নত আধারই পারে উন্নত চিন্তা- তরঙ্গসমূহকে ধারণ করতে। তাই দেহে-মনে উন্নত হও, পবিত্র হও, তাহলেই পারমার্থিক আনন্দ-গ্রহণের অধিকারী হবে ৷৷