গুরুমহারাজ:–‘তত্ত্ব’ শব্দটা এসেছে সংস্কৃত থেকে, সংস্কৃতে ‘তত্ত্বম্’ বা তৎ-ত্বম্ অর্থাৎ ‘You are That !’ সুতরাং ‘তত্ত্ব’ শব্দটি ‘চূড়ান্ত’- অর্থে ব্যবহার করাটাই সঠিক কিন্তু সাধারণতঃ আমরা যে কোনো বিষয়ের সংক্ষিপ্ত মর্মার্থ বোঝাতে ‘তত্ত্ব’ শব্দটা ব্যবহার করি। সেই অর্থে পুরাণের গল্পসমূহে তো প্রচুর ‘তত্ত্ব’ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এক-একটা ‘তত্ত্ব’-কেই পুরাণকারেরা গল্পের আকারে পরিবেশন করেছেন। মানুষকে তত্ত্ব-শিক্ষা দেবার এ এক অভিনব এবং ফলপ্রসূ style ! আজও যদি কোনো জটিল বৈজ্ঞানিক গবেষণার Theroy একেবারে আম-জনতা বা সাধারণ মানুষকে শেখাতে হয়, তাহলে রূপকাকারে অর্থাৎ গল্পের আকারেই শেখাতে হবে।
তুমি যে পৌরাণিক গল্পটির কথা বলছো অর্থাৎ হিরণ্যাক্ষ এবং হিরণ্যকশিপুর কাহিনী__ এর ঘটনাটা হোচ্ছে, বৈকুণ্ঠের দ্বারী ছিলেন জয় ও বিজয় নামে দুই ভাই। একদিন নারায়ণ বিশ্রাম নিচ্ছেন, এমন সময় সনকাদি ঋষিগণ তাঁর সাথে দেখা করতে গেলেন। কিন্তু জয় ও বিজয় প্রভুর বিশ্রামের ব্যাঘাত হবে বলে দেখা করতে দিলেন না। ব্যস, এতেই ঋষিদের রাগ এবং অভিশাপ – ‘যাঁর জন্য তাঁদের এত দরদ তাঁর কাছ হোতে বিচ্যুত হয়ে তাঁদের মর্তে জন্মগ্রহণ করতে হবে’। গোলমালে নারায়ণ বিশ্রাম ছেড়ে এসে দেখলেন যা হবার তা হয়ে গেছে। জয়-বিজয়ের করুণ অবস্থার কথা বিবেচনা করে উনি বিধান দিলেন যে, যদি জয়- বিজয় বিষ্ণুর ভক্ত হিসাবে মর্তে কাটাতে চান_ তাহলে সাত জন্ম পর তাঁদের মুক্তি ঘটবে, কিন্তু যদি তাঁরা বৈরীভাবে কাটাতে চান _তাহলে তিন জন্মেই তাঁদের মুক্তি! জয়-বিজয় শেষের শর্তে রাজী হয়ে গেলেন, ফলে ভক্তি সাধনায় শান্ত, দাস্য, সখ্য ইত্যাদি ভাবের সঙ্গে আর একটি ভাব যুক্ত হোলো ‘বৈরীভাব’ ! তবে বীরভক্ত ছাড়া বৈরীভাবের সাধন করা সম্ভব নয়। এরই ফলস্বরূপ তিন যুগে তিনবার এঁরা দু’জন ভগবানের শত্রুরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং প্রতিবারই ভগবানের হাতে তাঁদের নিধন হয়েছিল। এর মধ্যে সত্যযুগে অর্থাৎ প্রথম বারের দুই ভাই ছিলেন হিরণ্যাক্ষ এবং হিরণ্যকশিপু(পরবর্তী দুই জন্মে তাঁরা হয়েছিলেন যথাক্রমে _ত্রেতায় রাবন ও কুম্ভকর্ণ, দ্বাপরে শিশুপাল ও দন্তবক্র)।
স্থূলে হিরণ্যাক্ষ এবং হিরণ্যকশিপুর যে কাহিনী ওখানে পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় ভগবান শ্রীবিষ্ণু, বরাহ অবতাররূপে হিরণ্যাক্ষকে এবং নৃসিংহ অবতারে হিরণ্যকশিপুকে নিধন করেছিলেন। এ ছাড়া আরও পাওয়া যায় যে, বরাহ অবতাররূপে বিষ্ণু জলের মধ্যে থেকে দাঁতে করে স্থানচ্যুত হোতে থাকা পৃথিবীকে ধরে আবার সঠিক স্থানে স্থাপন করেছিলেন । এই সময় হিরণ্যাক্ষের দোর্দণ্ড প্রতাপে ও শক্তিমত্তা এবং অত্যাচারে পৃথিবীগ্রহটা মহাসাগরে ডুবে যাচ্ছিল _সেখান থেকেই পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিল বরাহ অবতার।
এক্ষেত্রে এই সমস্ত ঘটনাটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা তত্ত্বটি হবে যে__ হিরণ্যাক্ষ এখানে পৃথিবীগ্রহের বাইরে থেকে আসা ক্রিয়াশীল এমন কোনো মহাজাগতিক বল যা পৃথিবীর মহাকর্ষ বলকে দুর্বল করে দিচ্ছিলো। ফলে, পৃথিবীগ্রহটির অবস্থানের বিচ্যুতি ঘটে যাচ্ছিলো। বহিরাগত ক্রিয়াশীল বলটি পৃথিবীর কাছাকাছি কোনো ধূমকেতুর আগমনবশত হোতে পারে, উল্কাজাতীয় কোনো মহাজাগতিক বস্তুর হঠাৎ পৃথিবীর কক্ষপথে চলে আসা হোতে পারে—ইত্যাদি যে কোনো কারণেই হোক না কেন, ঐ সময় পৃথিবীগ্রহ তার অবস্থান থেকে বিচ্যুত হোতে চলেছিল। কিন্তু সেই অবস্থা থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিল। এখানে ‘বিষ্ণু’ বলতে অন্য একটি পৃথক তত্ত্ব__ যা সৃষ্টিকে ধরে রেখেছে অর্থাৎ Theory of sustaintion ! এই তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত force পৃথিবীকে পুনরায় পূর্বের অবস্থানে reset করে দিয়েছিল। এই মহাজাগতিক ঘটনায় যে বিশাল ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়েছিল, এতেই তৎকালীন পৃথিবীতে স্থলভাগ হয়তো ফালাফালা হয়ে গিয়েছিল ! এটাকেই– ‘বরাহ সমগ্র পৃথিবীকে দাঁতে করে কুরে দিয়েছিল’ এই হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এইভাবেই নির্দিষ্ট বিষয়ের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা পৌরাণিক গল্প থেকে খুঁজলে যেমন প্রাচীনকালের পৃথিবীর অনেক অজানা তথ্য আবিষ্কার করতে পারবেন, ঠিক তেমনি আধুনিক বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখার আবিস্কার হবে। তবে দ্যাখো, এই বিশ্বপ্রকৃতি বড়ই রহস্যময়, মানুষ আর কতোটুকুই বা এর রহস্য জেনেছে ? তাছাড়া তারা এই রহস্যের কতোটুকুই বা জানতে পারে !
স্থূল-সূক্ষ্ম-কারণ সাধারণত এই তিনরূপে জগৎ- সংসার প্রতিভাসিত। এর ঊর্ধ্বে মহাকারণ বা আদিকারণ– যা অরূপ অর্থাৎ যেখানে রূপ নেই। সুতরাং যে কোনো স্থূল ঘটনা— যা ঘটে চলেছে বা যা দৃশ্যমান হোচ্ছে, জেনে রাখবে তার সূক্ষ্মরূপ আছে এবং তার কারণরূপ ও আছে। হিরণ্যাক্ষ, হিরণ্যকশিপু, মহিষাসুর এরা কিন্তু সকলেই বাস্তবেও ছিল অর্থাৎ স্থূলেও ছিল, আবার সূক্ষ্ম জগতে বা কারণ জগতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বা মহাজাগতিক ঘটনারূপেও কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। স্থূল যে ছিল তার প্রমাণস্বরূপে গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে যে, বর্তমানের দক্ষিণভারতে সিংহাচল নামক স্থানে হিরণ্যকশিপুর রাজধানী ছিল। কারালাপ্পা মাহিষ্মতী বা মহিশূর ছিল মহিষাসুরের রাজধানী। ঐসব স্থানের জনশ্রুতি অনুযায়ী বা পরম্পরা অনুযায়ী মহিষাসুরের রাজ্য, তার নিধন যেখানে হয়েছিল__ ইত্যাদির স্থানও চিহ্নিত করা আছে।
ভাবনা-ইচ্ছা-ক্রিয়া, কারণ-সূক্ষ্ম-স্থূল এই ক্রমেই কারণজগতের ভাব বা ভাবনা সূক্ষ্মজগতে ইচ্ছায় রূপ নেয়। স্থূলরূপে তা ক্রিয়া বা কার্যে যখন রূপ-পরিগ্রহ করে তখন তা সকলের কাছে দৃশ্যমান হয়। তখন সকলে বলে ঐ ঘটনাটা ঘটেছে, কিন্তু বাস্তবে ঘটনার বীজ কিন্তু অনেক আগেই পোঁতা হয়েছে, শুধু সত্যটি দৃশ্যমান হোলো পরে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অধ্যাত্মবিজ্ঞানী ছিলেন, তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে এসব কথার সত্যতা নিজে practical করে দেখিয়ে গিয়েছিলেন। রাধাভাবের সাধন করতে করতে তাঁর মধ্যে নারীর ধর্ম প্রকাশ পেল-মেয়েদের মতো মাসিক ঋতুচক্র শুরু হয়ে গেল। ভাবনার ফল ক্রিয়াতে স্থূলরূপ নিল। প্রকৃত রামায়ণের হনুমান কেমন ছিল সেকথা থাক । কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সাধারণ বানর-হনুমানকেই চিন্তার জগতে রেখে যখন হনুমান-সাধনা শুরু করলেন_ তখন কথিত আছে যে, তাঁর নাকি Perinium-এর নিচে দেড় থেকে দুই ইঞ্চি লেজ গজিয়ে ছিল ! সুতরাং দেখা যায় যে, চিন্তার জগতের প্রতিফলন স্থূল শরীরের উপর ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে এবং এটা জীবন বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেন। তাহলে এবার নিশ্চয়ই বোঝা গেল যে, যে কোনো ঘটনার পিছনেই রয়েছে কোনো না কোনো তত্ত্ব। আবার যে কোনো তত্ত্বের ব্যাখ্যামূলক রূপই হোচ্ছে কোনো না কোনো ঘটনা।।