জিজ্ঞাসু:—জাপানের মতো ক্ষুদ্রদেশ অর্থনীতিতে, প্রযুক্তিতে প্রচন্ড উন্নতি করলো কিন্তু ভারতে বহুকাল থেকে কত মহাপুরুষ জন্মেছে তবুও সবেতেই তো এই দেশটা এখনও পিছিয়ে রয়েছে— এর কারণ কি ?

গুরুমহারাজ:—এক-একটা দেশ বা জাতির জাতীয় চরিত্রের এক একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রাজশক্তির উচিত সেই দেশের জাতীয় চরিত্র অনুযায়ী জাতিটিকে পরিচালিত করা। জাতীয় চরিত্র বলতে যেমন— জাপানের দেশপ্রেম, ভারতের আধ্যাত্মিকতা, ফ্রান্সের স্বাধীনতাপ্রিয়তা, ইংল্যাণ্ডের বাণিজ্যপ্রিয়তা ইত্যাদি। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন—”আধ্যাত্মিকতাই ভারতের প্রাণশক্তি”। কিন্তু মহাপুরুষদের কথাকে উপেক্ষা করে বহুকাল থেকে ভারতবর্ষের রাজশক্তি জনগণকে অন্য পথে পরিচালিত করছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এদেশের রাজনৈতিক নেতারা ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে বিভিন্ন বিদেশী-মতবাদকে জোর করে সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, সুতরাং বিপরীত প্রতিক্রিয়া তো দেখা দেবেই সমাজে !

তবে তুমি ভারতবর্ষের অবস্থা যতোটা খারাপ ভাবছো, ততোটা কিন্তু খারাপ অবস্থা ভারতের নয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিও ভারতকে এখন (১৯৯১-৯২সাল) যথেষ্ট মর্যাদা দেয়। বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ম্ভর দেশ ভারতবর্ষ। এখন এদেশে নানারকম শিল্প রয়েছে, অর্থনৈতিক দিক থেকে এবং প্রতিরক্ষাতেও ভারত খুব পিছিয়ে নেই। ভারতের যেটা মূল সমস্যা সেটা হোচ্ছে অত্যধিক জনসংখ্যা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বন্টন ব্যবস্থার অসাম্যতা। এই দুটি নিয়ন্ত্রিত হোলেই বিশ্বে ভারতের position আরও সম্মানজনক হয়ে যাবে—এটা তোমাদের বলে রাখছি।

তবে জাপানের উন্নতির কথা যেটা বলছিলে _সেটা সত্যিই শিক্ষণীয়। দেশপ্রেম ওদের কাছে শিখতে হবে বিশ্বকে। পূর্বে পূর্বে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলি যে ভাবে ঐ দেশকে শোষণ করেছে এখন জাপান তার শোধ নিচ্ছে অর্থাৎ জাপানই যেন এখন গোটা বিশ্বকে শোষণ করছে তার উন্নত Technology-র দ্বারা। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি, বিশ্বের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ৭০ ভাগ বাজার এখন(১৯৯১-৯২) জাপানের দখলে। অন্যান্য উন্নত দেশগুলির Technology-কে fail করে দিয়ে জাপান সেখানে ঢুকে পড়ছে। বিভিন্ন দেশের বহু কোম্পানী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে— কারণ তারা জাপানের উন্নত Technology-র সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না, তাদের মাল unsold অবস্থায় পড়ে থাকছে। কি অবস্থা ভাবো একবার !

কিন্তু একথা কখনই ভেবো না যে, জাপান হঠাৎ করে উন্নতিলাভ করেছে। চিরকালই ওরা নিজেদের দেশের ব্যাপারে সচেতন। চীন অতবড় রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাস খুলে দেখো যে, অতীতে জাপানীরা চীনের কিছু রাজ্য দখল করে রেখেছিল, কিন্তু চীন কখনও ঐটুকু রাষ্ট্রকে দখল করতে পারেনি। কোনো কোনো সময় এই দেশের সংকটকাল দেখা দিলেও দ্রুত ওরা আবার নিজেদের অবস্থার উন্নতিসাধন করে ফেলেছে। এ ব্যাপারে কোনো উন্নত জাতির ভাব গ্রহণ করতেও ওরা দ্বিধাবোধ করে না—এসব sentiment ওদের নেই, দেশের উন্নতিই শেষ কথা। ওরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেছে—ওদের নিজেদের অস্ত্র নিয়ে, এটাও ভাববার বিষয় । এই সবকিছুর পিছনে একটাই বিশেষ গুণ ওদের চরিত্রে দেখা যায়—তা হল দেশপ্রেম। আজও কোনো জাপানী সামাজিকভাবে সাংঘাতিক কোনো অপরাধ করলে বা দেশের প্রয়োজনে কোনো কাজ করতে গিয়ে failure হোলে ‘হারিকিরি’ করে suicide করে। এটা জাপানে খুবই হয় – ওরা বরফগলা জলে পা ডুবিয়ে দিয়ে পায়ের গোড়ালির কাছে main শিরাদুটো কেটে দেয়, এতে শরীরের সমস্ত রক্ত বেরিয়ে গিয়ে ব্যক্তিটি মারা যায়। এছাড়া ওদের দেশপ্রেমের আর একটা বড় প্রমাণ হোলো—দেশটা তো বিভিন্ন সময়ে দুরাবস্থার মধ্যেও লড়েছে কিন্তু কখনই কোনো অবস্থায় ওদের দেশবাসী migrate করেনি ! পৃথিবীর অন্যান্য দেশের লোক কিন্তু প্রায়শঃই এটা করে থাকে–সমস্যা সৃষ্টি হোলেই migrate করে। জাপানি রা কোনো অবস্থাতেই এটা কখনো করে নি। কোনো জাতির দেশপ্রেমের এটা একটা অন্যতম প্রমাণ জানবে। শরশয্যায় ভীষ্ম পাণ্ডবদের জিজ্ঞাসার উত্তরে একথা বলেছিলেন যে, “প্রকৃত দেশপ্রেমিক হোলেন তিনিই—যিনি চরম সংকটে দেশত্যাগ না করেন ”।