জিজ্ঞাসু:—‘বেদে’-দের নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনী সমাজে প্রচলিত রয়েছে, সম্প্রতি বাংলাতে একটা চলচ্চিত্রও হয়েছে এদের নিয়ে। এদের সম্বন্ধে যদি একটু বিস্তারিত কিছু বলেন ৷

গুরুমহারাজ:—হ্যাঁ, film-টা হয়েছে বাংলাদেশের বেদেদের নিয়ে, ওখানেও ওদের ‘বেদে’-ই বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই জনগোষ্ঠীর লোকেরা রয়েছে। ওদের কোনো কোনো group নিজেদের কে ‘ইরানী’ পরিচয় দেয়, কোনো দেশে ওদের Gypsy-ও বলে। ‘জীপসী’ কথাটা আবার ইজিপ্সিয়ান থেকে এসেছে, ফলে অনেকে বলে যে ওরা Egypt অর্থাৎ মিশরের লোক।

বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেও ওরা কিন্তু একই জনগোষ্ঠীর লোক! নানা দেশে ওদেরকে নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে, ওদেরকে নিয়ে research-ও হয়েছে প্রচুর। তাতে জানা গেছে যে, ওরা originally রাজস্থানের লোক—এটাই ছিল ওদের আদি বাসভূমি। যে কোনো কারণেই হোক- পরে পরে ওরা পৃথিবীর নানা স্থানে migrate করে। এদেশে মুসলমান শাসকদের শাসনকালে ওরাও মুসলমান হয়ে যায়। হয়তো কোনো ইরানী ধর্মগুরুর দ্বারা ওদের কোনো group ধর্মান্তরিত হয়েছিল _বলেই তারা নিজেদেরকে ‘ইরানী’ বলে পরিচয় দেয়। আবার যেহেতু ওদের একটা group মিশর হয়ে ইউরোপে ঢুকেছিল– তাই ইউরোপীয়রা ওদেরকে ‘জীপসী’ অর্থাৎ ইজিপ্সিয়ান নাম দিয়ে দিল। এই ভাবেই বিভিন্ন সময়ে ওদের নানা দেশে নানান নামকরণ হয়েছে।

তবে এইসব নিয়ে ওদের(বেদেদের )কোনো মাথাব্যথা নাই, ওরা সবসময়ই ছোটো ছোটো দলে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। যে দেশেই ওরা থাকুক না কেন, বেদেরা হয়তো সেই দেশের সাজ-পোশাক, খাবার-দাবার, ভাষা ইত্যাদি হয়তো গ্রহণ করেছে, হয়তো সেখানকার প্রচলিত ধর্মমত‌ও গ্রহণ করেছে
কিন্তু ওদের জীবনযাত্রার style সব জায়গাতেই একই রয়ে গেছে। ওই যে বলা হোলো ওরা ছোটো ছোটো দলে ঘুরে বেড়াতো, সত্যি সত্যিই ওদের যাযাবর জীবন ! আমাদের দেশে দেখা যায় ওরা যেন ঠিক বর্ষাকে পিছনে পিছনে রেখে ঘুরে বেড়ায়, তারপর বর্ষাকালটা কাটায় রাজস্থানে অথবা কম বৃষ্টিপাত হয় এমন কোনো অঞ্চলে। দেখবে গ্রামে-গঞ্জে ওরা মাঠের ধারে তাঁবু খাটায়, কলকাতা শহরেও ওদের তাঁবু দেখেছি। খেয়াল করলে দেখতে পারবে যে, প্রতিবছরই একটা নির্দিষ্ট সময়ে ওরা নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে ফিরে আসে।

ওদের দলে একজন সর্দার বা দলপতি থাকে। ওদের দলের যে কোনো সমস্যার বিচারক তিনিই। ওরা কোনো সমাজনীতি বা রাজনীতির ধার ধারে না। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মেটায়, নিজেদের বিচার নিজেরাই করে। দলের মেয়েরা সাধারণত নানারকম জাদুখেলা বা কসরত দেখিয়ে অথবা পশু-পাখীর নাচ দেখিয়ে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে ঘুরে ঘুরে চাল-পয়সা আদায় করে নিয়ে আসে। আর পুরুষেরা পাখী বা বিভিন্ন ছোটো ছোটো বন্য পশু যেমন—কটাশ, বুনো খরগোস, কাঠবেড়ালি ইত্যাদি শিকার করে বেড়ায়—এমনকি ছোটখাটো চুরি-চামারিও করে থাকে। যৌনসংসর্গের ব্যাপারে ওদের মেয়েরা সংস্কারমুক্ত। বাংলায় ‘বেদো’ গালা-গালিটা এখান থেকে এবং এইজন্যই এসেছে। সর্দারের মনোরঞ্জন করতে পারলে বা তার অনুমতি পেলে যে কোনো সাধারণ মানুষ বেদের মেয়েদের সঙ্গে সঙ্গ করতে পারে। কিন্তু ওরা কখনই বাইরের কোন পুরুষের সাথে ওদের সমাজের মেয়ের বিবাহ হোক, এটা মেনে নিতে পারে না। এমনকি বাইরের পুরুষের সঙ্গ করলেও তার দ্বারা সন্তান উৎপাদন করার ব্যাপারেও ওদের সমাজে restriction রয়েছে কিন্তু এইটা প্রায়শঃই টেকে না। তাই বাইরের মানুষের সাথে ওদের মেয়েদের মেলামেশা মেনে নিলেও কিন্তু ওদের বাইরের গোষ্ঠীর লোকের সাথে বিবাহের ব্যাপারে ওরা ভীষণ serious ! এমন‌ ঘটনাও ঘটে গেছে যে, ওদের সমাজের কোনো মেয়ের সাথে বাইরের কোনো পুরুষের হয়তো ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল এবং পরে হয়তো তারা অন্য কোথাও পালিয়ে গিয়ে বিবাহও করেছিল, কিন্তু ওদের গোষ্ঠীর লোকেরা তাকে খুঁজে বের করে মেরে দিয়ে এসেছে।

তবে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ওদের নিয়ে সবচাইতে বেশী research হয়েছে। কারণ সমাজতন্ত্র আসার পর ঐ সব দেশে প্রত্যেক নাগরিককে খাদ্য, আশ্রয় এবং কর্মসংস্থান দেবার ভার সরকারের। ফলে ঐ সব দেশের ‘বেদে’দেরকেও বসবাসের জন্য কোয়ার্টার দেওয়া হয়েছিলো এবং রেশনকার্ড‌ও দেওয়া হয়েছিলো । এমনকি ওদের জন্য নির্দিষ্ট কর্মসংস্থানও করে দেওয়া হয়েছিলো। সমাজতান্ত্রিক দেশের আইন জানো তো— সরকারী ব্যবস্থার অবমাননা করা মানেই Red-guard-এর হাতে মৃত্যু। ফলে ওরা বাধ্য হয়ে দেশের আইন মেনে নিয়েছিল । তবে ওরা সরকারের সঙ্গে কি শর্ত করেছিল জানো__ যে, ওরা কৃষিকাজ বা কোনো পেশাগত কাজ করবে না। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! তার মানে বহু পূর্বে অর্থাৎ সমাজসৃষ্টির প্রারম্ভিক দিকে যে দুটো main শাখায় মানবগোষ্ঠী বিভক্ত হয়েছিল, তার একটা ছিল পশুপালক গোষ্ঠী এবং অপরটি কৃষিজীবী ! ওদের মধ্যে যারা কোনো না কোনো স্থানে settled হয়েছিল_তারাই হয়ে উঠেছিল কৃষিজীবী । আর অপর গোষ্ঠীটি যাযাবর জীবনযাপন করতো, তারা ছাগল, ভেড়া, গরু, শুয়োর ইত্যাদি পশুপালন করতো। এই বেদেরাই যে সেই প্রাচীন পশুপালক গোষ্ঠীর শাখা তা ওদের শর্ত দেবার ধরণ দেখেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো।

আজও লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে _ওরা যেখানে যেখানে তাঁবু খাটায় সেখানে ওদের সাথে দু- একটা ঘোড়া, কিছু ছাগল অথবা শুয়োর ইত্যাদি থাকে। তাছাড়াও ওদের সঙ্গে বানর, ভল্লুক, সাপ এসবও থাকে। Communist country-গুলোতে যখন পাকাপাকিভাবে ওদের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হোলো তখন দেখা গেল _ প্রথম প্রথম ওরা সরকারী অনুশাসনের ভয়ে চুপচাপ সবকিছু মেনে নিলেও কিছুদিন পর থেকে দেখা গেল যে, ওরা কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে গাছতলায় তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছে ! সেই সময় সোভিয়েত রাশিয়ায় ওদের একটা Television সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। ওদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সামনেই ওদের জন্য নির্দিষ্ট কোয়ার্টার থাকা সত্ত্বেও ওরা এত কষ্ট(সোভিয়েত রাশিয়ায় শীতকালে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে) করছে কেন ? কারণ ইউরোপ শীতের দেশ _ওসব দেশে বাইরে রাত কাটানো খুবই কষ্টের ! ওরা উত্তর দিয়েছিল, “ঘর নয়, খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত পরিবেশটাই সবচেয়ে আরামদায়ক”। রাশিয়ায় যখন ‘গ্লাসনস্ত’ এবং ‘পেরেস্ত্রৈকা’ শুরু হোলো ওখানকার প্রেসিডেন্ট গরবাচেভের সময়, তখন ওদের আনন্দ দেখে কে ? ওরা আবার Caravan নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো রাস্তায়। আবার ওরা স্বাধীন, আবার ওরা যাযাবর! রাশিয়ার ৭০ বছরে communist শাসনে ওদের কয়েক পুরুষ কেটে গেছে। কিন্তু যেহেতু রক্তে রয়েছে পরম্পরাগত অভ্যাস বা সংস্কার, সেই সংস্কার কাটলো না। সুযোগ যেই পেলো_ওরা বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। ওদের বোহেমিয়ান জীবন, বাউন্ডুলে জীবন—এই জীবনেই ওরা অভ্যস্ত, তবে এটা খারাপ তো কিছু নয় !!