জিজ্ঞাসু :—মহারাজ, আমি স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ। আমি স্বামিজীর বইগুলি পড়েছি—এখন আপনার আলোচনাও শুনছি, কিন্তু আপনি নানারকম প্রসঙ্গ আলোচনা না করে শুধু তো যুবকদের কর্মযোগে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, কারণ এযুগে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ এবং সবচাইতে প্রয়োজনীয় নয় কি ?

গুরুমহারাজ:—তুমি কি করো ? ও–, বিবেকানন্দ যুবমণ্ডলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছো, তা বেশতো—ভালোই। কিন্তু দ্যাখো— জগতের সবাইকে তো এক category-তে ফেলা যায় না আর পৃথিবীর সকলেই কর্মযোগী হবেও না, হবে কি ! মুখে ‘কর্মযোগ’-‘কর্মযোগ’ করলেই কর্মযোগী হওয়া যায় না_ কর্মযোগ হোলো খুব কঠিনযোগ ! প্রকৃত কর্মযোগী হবেন ঠিক যেন ধূপের মতো, নিজে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে_ আর শুধুই চারিদিকে সুগন্ধ ছড়াবে কিন্তু বিনিময়ে কিছুই চাইবে না। উপযুক্ত গুরুর সাহায্য ছাড়া কর্মযোগ অভ্যাস করতে গেলে মহামায়ার মায়ায় ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। অন্যান্য যোগ অপেক্ষা কর্মযোগকে কেন কঠিন বলছি জানো— এক্ষেত্রে যোগীকে সাধারণ জনসাধারণের সঙ্গে direct সংযোগ বা সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। আর যাদের হয়ে বা যাদের জন্য কাজ করা হয়, তারাই এমন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-কটূক্তি করবে যে, সেইসব সহ্য করা মুস্কিল হয়ে পড়ে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সাধক এতেই reaction করে ফেলে—আর reaction করা মানেই ব্যস্ __ ঐ যোগী ফেঁসে যায় অর্থাৎ যোগভ্রষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এইসময় যদি সদগুরু তোমার পাশে থাকেন, তাহলে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন ! তিনি সঠিক পথ বাতলে দেবেন ! অন্যথায় যোগীর পদস্খলন হবার খুবই সম্ভাবনা থাকে।

স্বামী বিবেকানন্দের মতো তেজস্বী, শক্তিশালী মহাপুরুষ আধুনিক সমাজে কর্মযোগ শুরু করেছিলেন বলেই এই পরম্পরায় এখনও কাজ চলছে –অনেক প্রতিষ্ঠানে এ সব কাজ কিছুদিন চলার পর বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মযোগ যার-তার জন্য নয় । একমাত্র অবতার-পুরুষরা কারও সাহায্য ব্যতিরেকেই নিষ্কামকর্ম করতে পারেন কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে গুরুর দরকার হয়।

ভগবান বুদ্ধের শিক্ষা ছিল, “আত্মনোমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ” —স্বামী বিবেকানন্দও এই কথা তাঁর সারাজীবনে follow করেছেন এবং সকল মানুষকে follow করতে বলেছিলেন। এখানে দুটি ধারার কথা বলা হয়েছে, ‘আত্মনোমোক্ষার্থং’ এবং ‘জগদ্ধিতায়’। সুতরাং সবাইকে জগতের হিতে কাজ করতে হবে- এমন কথা নয়। ‘আত্মমোক্ষার্থে’-ও অনেকে ব্রতী হোতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ দুটোর মধ্যে যে কোনো একটা করলেই জগতের হিত হবে। অনেকে ভাবে যে, জগতের হিত করতে গেলে ঐশ্বর্য বা টাকা-পয়সার প্রয়োজন, অনেক শিক্ষা বা education-এর প্রয়োজন কিন্তু এই কথাও ঠিক নয়। ঐসব দিয়ে দু-চারটে স্কুল বা হসপিট্যাল প্রতিষ্ঠা হোতে পারে, স্থানীয়ভাবে কিছু মানুষের হয়তো হিতসাধন হোতে পারে কিন্তু সামগ্রিক মঙ্গল কিছু হয় না। যারা মোক্ষলাভ করেছেন তাঁরাই পারেন জগতের প্রকৃত কল্যাণ করতে বা সকলের হিতসাধন করতে ! আত্মত্যাগের মহিমাতেই মানুষ মহান হয়। অপরপক্ষে আত্মসুখের ইচ্ছা থেকে আত্মগ্লানি আসে, আর আত্মগ্লানি থেকে আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটে থাকে। ফলে তখন কর্মযোগ তো দূরের কথা__তাদের দ্বারা কোনো ভালো কাজই হয় না ! আত্মিক উত্তরণের জন্য চাই প্রবল আত্মবিশ্বাস। যার এটা আছে, তার সবই আছে।

জেনে রাখবে জগতে ‘সত্যই বল (Strength)’ । মানবজাতির ইতিহাস খুলে দ্যাখো, এইজন্যই যুগে যুগে বার-বার সম্রাটের মুকুট কোনো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর পদতলে লুটিয়ে পড়েছে।

সুতরাং ঐশ্বর্য, শারীরিক বল, eduction ইত্যাদি বিষয় যাদের রয়েছে, তারা শ্রেষ্ঠ নয়—আত্মসুখের ইচ্ছা ত্যাগকারী নিষ্কাম কর্মযোগীই শ্রেষ্ঠ। ঠিক ঠিক কর্মযোগী হোতে গেলে আগে Head, Heart এবং Muscle-এর পূর্ণ manifestation দরকার। আর তার জন্য জীবনে সংযম, নিষ্ঠা ও অভ্যাসযোগের একান্ত প্রয়োজন।

আর একটা জিনিস জেনে রাখবে দল বেঁধে চুরি-ডাকাতি করা যায়, মানুষের সেবাও করা যায় কিন্তু আধ্যাত্মিকতা দল বেঁধে লাভ করা যায় না। Individual-কেই উন্নত হতে হয় এবং তা করতে হয় কোনো না কোনো উন্নত আদর্শকেই সামনে রেখে। ভগবান বুদ্ধ বলতেন “আত্মোদীপো ভব”।এই কথার একটা অর্থ যেমন _”আত্মা দীপ-স্বরূপ” তেমনি অন্য অর্থও করা যায়। একটি জ্বলন্ত প্রদীপই পারে অনেক প্রদীপকে জ্বালাতে ! স্বামী বিবেকানন্দ যখন ব্রহ্মানন্দে ডুবে থাকতে চাইলেন তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে তীব্র ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, “তুই বটবৃক্ষ হ”। সেইদিনের নরেন দত্ত ভগবান ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব গ্রহণ করে কর্মযোগী স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ সমস্ত পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েও দশ জন ঠিক ঠিক কর্মযোগী পান নি। তিনি একবার বলেছিলেন—যদি ঠিক ঠিক ত্যাগী দশ জন যুবক পান তবে পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি তা পান নি। তাহলেই বুঝতে পারছো—দলে দলে কর্মযোগী পাওয়া বা তৈরী করা সম্ভব নয়, আর সে চেষ্টা করাও বৃথা!

তবে স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তা বা তাঁর প্রচেষ্টার সূক্ষ্মরূপ আজও প্রবহমান ! তাই তোমাদের মত যুবকেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কর্মযোগে ব্রতী হোতে এগিয়ে আসছে—এটাও কম কথা নয়। অতএব সমাজে যে আগের তুলনায় অনেক বেশী সংখ্যক কর্মযোগী বিবেকানন্দের চিন্তায় বা তাঁর প্রচেষ্ঠায় কাজ করছে—এটা নিশ্চিত। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যদি কেউ এগিয়ে আসতে চাও আমি সবসময় welcome জানাবো। যে কোনো সৎ ও শুভকাজে আমার সর্বদা আশীর্বাদ রয়েছে। আর এটাও জেনে রেখো যে, উদ্দেশ্য বা সংকল্প যদি ‘বহুজনহিতায়’ হয়, তাহলে সেই কাজে অর্থের বা লোকের অভাব হয় না। এগুলি সত্যি জানবে, এগুলি universal principle __মহাকালের নিয়মে কখনও ভুল হয় না।