বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন
15-th October, 1992

জিজ্ঞাসু:—বিভিন্ন চক্র এবং ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না বা কুলকুণ্ডলিনী এগুলি শরীর ব্যবচ্ছেদ করে পাওয়া যায় না কেন ?

গুরুমহারাজ:—ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না এগুলো সবই field অর্থাৎ শক্তির ক্ষেত্র। বিভিন্ন চক্রগুলি হোচ্ছে বিভিন্ন এন্ডক্রিন গ্ল্যাণ্ড বা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি। মানুষের দেহে যত স্নায়ুজাতীয় fibre বা তন্তু রয়েছে সেগুলোকে যদি পরপর আনুভূমিকভাবে সাজানো হয়, তো সেগুলি এই পৃথিবীর সাড়ে তিন পাকে ঘুরে আসবে। ঠিক এই একই ভাবে কুলকুণ্ডলিনী মূলাধারে সাড়ে তিন পাকে জড়িয়ে নিদ্রিত অবস্থায় থাকে। যোগশাস্ত্রে ৭২০০০ (বাহাত্তর হাজার) নাড়ীর কথা উল্লেখ রয়েছে—এসব Anatomy শাস্ত্রে এখনও আসেনি। ৭২০০০ নাড়ীর মধ্যে ১৪টি নাড়ী প্রধান। এইগুলি আকুপাংচার চিকিৎসার meridian। ১৪টি নাড়ীর মধ্যে আবার তিনটি নাড়ী উল্লেখযোগ্য, এরাই ইড়া, পিঙ্গলা এবং সুষুম্না। ইড়া শরীরের বামভাগে, পিঙ্গলা শরীরের ডানভাগে এবং সুষুম্না শরীরের মধ্যভাগে governing vessel-এর Spinal cord এর মধ্য দিয়ে লম্বভাবে বিরাজমান থাকে । এই তিনটি field-কে কাজে লাগিয়ে উত্তরণের কৌশলই পুরাণে গল্পাকারে সমুদ্রমন্থনরূপে বর্ণনা করা আছে। ইড়া দেবপ্রকৃতি, পিঙ্গলা দানবপ্রকৃতি আর সুষুম্না ও কুলকুণ্ডলিনী যথাক্রমে মন্দারপর্বত এবং বাসুকীনাগ, যাদের সাহায্যে মন্থন করা হয়। এখানে দ্যাখো, উদ্দেশ্য হোচ্ছে অমৃতলাভ কিন্তু তা লাভের জন্য দেব এবং অসুর উভয়কেই প্রয়োজন অর্থাৎ শরীরের শুভশক্তিসমূহ দেবতা আর রিপুশক্তি বা অশুভশক্তিসমূহ অসুর কিন্তু আত্মজ্ঞানলাভের পথে উভয়কেই দরকার হয়। সমুদ্রমন্থনকার্যে অসুরদের সহযোগিতাকে যেমন কাজে লাগানো হয়েছে, তেমনি সাধকের ক্ষেত্রে রিপুশক্তিকে channelised করাটাই art বা কৌশল।

এবার মন্থনকালে একে একে নানারকম লোভনীয় সামগ্রী উঠে আসছে—উচ্চৈঃশ্রবা, ঐরাবত ইত্যাদি_ যেগুলি সাধকের জীবনে নানান সিদ্ধি। এগুলো পাওয়া হয়ে গেলেও মন্থন থামালে চলবে না, আসল উদ্দেশ্য হোলো অমৃত লাভ ! সুতরাং এগিয়ে চলো _চরৈবেতি! মন্থনের শেষকালে উঠেছিল অমৃত কিন্তু দ্যাখো অমৃতের প্রায় সাথে-সাথেই উঠেছিল বাসুকির কালকূট বা হলাহল — যা গ্রহণ করার ক্ষমতা সুর বা অসুর কারও ছিল না। তাই তা গ্রহণ করতে হোলো মহাদেব বা শিবকে।

আমি তোমাদের তত্ত্বটা পরে বলছি। আগে সমুদ্র মন্থনের পরবর্তী গল্পটা শোনো। অমৃতভাও উঠে আসতেই যেহেতু অসুররাজ বিরোচন সবচেয়ে শক্তিমান, তাই সে ভান্ড দেবতাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েই ছুট লাগালো আর পিছনে পিছনে দেবতারা ওদেরকে তাড়া করলো। ইন্দ্রপুত্র জয়ন্তের গতি ছিল সবচেয়ে দ্রুত, সে গিয়ে বিরোচনের হাত থেকে ভান্ড কেড়ে নিয়ে উল্টোদিকে ছুটলো, তার সঙ্গে ছিল দেবতারা। এবার অসুরগণ আবার তাদের পিছনে তাড়া করলো। দেবতারা প্রথম ভান্ড নামাল নাসিকে। সেখানে ভান্ড নামিয়ে তাড়াতাড়ি করে অমৃত সবাই খেতে যাবে এমন সময় হৈ-হৈ করতে করতে অসুরেরা এসে হাজির! আবার দেবতারা ভান্ড নিয়ে দে ছুট্। তাড়াতাড়ি যাবার সময় ছলকে কিছুটা অমৃত মাটিতে পড়ে গেল। এইভাবে দেবতারা আরও দু’জায়গায় অর্থাৎ উজ্জয়িনী এবং প্রয়াগে । সেখানেও দেবতারা ভান্ড নামিয়ে অমৃত খাবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেই দু-জায়গাতেই অমৃত ছলকে ছলকে খানিকটা করে পড়ে গিয়েছিল। অবশেষে ওরা পৌঁছেছিল হরিদ্বারে। সেখানে বিষ্ণুর মোহিনী মূর্তির আবির্ভাব ঘটলো এবং মোহিনীর ভূবনমোহিনীরূপে সবাই বিমোহিত হয়ে গেলো। ফলে বিরোধ গেল থেমে, মোহিনী সিদ্ধান্ত করলো যে, সে নাচতে-নাচতে ও গাইতে গাইতে সবাইকে অমৃতপ্রদান করবে। কিন্তু মোহিনী মায়ার কৌশলে দেবতাদের খাওয়ালো অমৃত আর অসুরদেরকে খাওয়ালো সুরা। ‘রাহু’ নামে এক রাক্ষস ব্যাপারটা ধরে ফেলায় সে দেবতা সেজে অমৃত খেয়েছিল কিন্তু চন্দ্র তাকে চিনতে পারায় হৈ-চৈ বাধালো। সঙ্গে সঙ্গে তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হল। যেহেতু সে অমৃত পান করে ফেলেছে তাই তার মুণ্ড ও ধড় দুটো অংশই পৃথক পৃথক ভাবে বেঁচে রইলো__ ‘রাহু’ এবং ‘কেতু’রূপে। এরপর অমৃতের বলে বলীয়ান দেবতারা অসুরদের বিনাশ করে পুনরায় স্বর্গরাজ্যের অধিকার ফিরে পেল। এদিকে শুক্রাচার্য খবর পেয়ে মৃতসঞ্জীবনী ছিটিয়ে মৃত অসুরদের জীবিত করে নিয়ে চলে গেল অসুরদের রাজ্যে।

এই হোলো গল্পটা। এবার এর অন্তরালে যে সত্য আছে সেটা বলছি শোনো। সাধক যখনই সমুদ্রমন্থন শুরু করে অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনীকে কাজে লাগিয়ে ব্রহ্মগ্রন্থির উপরে মনকে উঠাতে শুরু করেন_ তখনই রিপুরা আরও প্রবল হয়ে তাকে নিচে নামাতে চায়। এটাই ‘বিরোচনের ভাণ্ড’ নিয়ে উল্টো দিকে ছোটার রহস্য। এবার ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গণের রাজা ‘মন’-এর একটা সহস্র faculty-র মধ্যে একমাত্র ‘সংকল্প'(ইন্দ্রিয়-পুত্র)-ই পারে সাধককে সমস্ত অশুভশক্তির বাধা কাটিয়ে আবার স্বাভাবিক পথে নিয়ে যেতে। এখানে নাসিক, উজ্জয়িনী, প্রয়াগ (যে সব স্থানে আজও স্থূলে কুম্ভমেলা হয়) হোলো মানবশরীর অভ্যন্তরস্থ অনাহত, বিশুদ্ধ এবং আজ্ঞাচক্র। এইসব স্থানে ছলকে অমৃত পড়ার অর্থ__ ঐ সব চক্র ভেদকালে সাধকের নানান অনুভূতি ও উপলব্ধি হোতে শুরু হয়, আনন্দের আস্বাদন হয়। এরপর ‘হরিদ্বারে অমৃতের ভান্ড ভাঙা হোলো বা অমৃতরসের আস্বাদন হোলো _সহস্রারে পরমানন্দের সম্পূর্ণ আস্বাদন। সহস্রারে পৌঁছে গেলে সাধক অভয় হ’ন এবং রিপুগণ সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়। এটাই শিব অবস্থা। আর শিবই পারেন ভূ-ভার হরণ করতে, জগৎ-সংসারের ত্রিতাপ ক্লেশরূপ যে হলাহল বা কালকুট তা পান করতে ! কিন্তু পৃথিবীর এই ত্রিতাপ জ্বালাকে শরীরে ধারণ করারও তো জ্বালা রয়েছে। তখনই সাধকের ভাগবতী তনুকে জ্বালামুক্ত করার জন্য প্রয়োজন হয় তারামায়ের দুগ্ধরূপী সুধা। এখানে ‘তারা’ অর্থে নীলতারা বা বজ্রতারা, যা তন্ত্রসাধনার সর্বোচ্চস্তরের দেবী। সুষুম্নার মধ্যে থাকে বজ্রানাড়ী, নির্বিকল্প সমাধি লাভের পর এই নাড়ীর ক্রিয়া শুরু হয়। বজ্রানাড়ী উদ্দীপ্ত হোলে সহস্রার থেকে চন্দ্রবারুণী-সুধা নিঃসৃত হয়, যা পান করে ঐ মহাসাধক জগতের যে কোনো ক্লেশ শরীরে গ্রহণ করতে পারেন আবার তা হজমও করে নিতে পারেন। তন্ত্রের ভাষায় এই সুধাই “মহাকারণ”–স্থূলের মদ বা ‘কারণ’ নয়। এই কারণের নেশাই প্রকৃত নেশা, যার taste পাবার জন্য‌ই বিকল্প নেশার সৃষ্টি হয়েছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গান গাইতেন, “সুরা পান করিনে আমি, সুধা খাই জয় কালী বলে”। এই সেই সুধা—যার বাস্তব উদাহরণ ঠাকুর বহুবার তাঁর সামনে উপস্থিত সাঙ্গ-পাঙ্গদের দিয়েছেন। কারণ বহুবারই এমন হয়েছে যে, নাম করতে করতে ঠাকুর সমাধিস্থ হয়ে গেছেন আর সাধারণ মাতালদের মতো তাঁর পা টলে টলে গেছে অথবা তাঁর কথা জড়িয়ে গেছে !

তারপর ঐ যে শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী দিয়ে তার সঙ্গীদের নিয়ে চলে গেল—এটা আবার শরীর অভ্যন্তরস্থ রিপুগণের নতুন লড়াই-এর প্রস্তুতি। প্রকৃতিতে অশুভশক্তি কখনও সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয় না। উপযুক্ত ক্ষেত্র পেলেই আবার তারা ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। ফলে পুনরায় শুরু হয় লড়াই। পূর্বে যে স্থান বা ‘ক্ষেত্রে’ লড়াই হয়েছিল সেখানে আর লড়াই হয় না_অন্যত্র হয়।

দ্যাখো, সেই অর্থে গোটা পৃথিবীটাই তো যুদ্ধক্ষেত্র ! স্থান-কাল-পাত্র উপযুক্ত হোলেই সেখানে আবার রিপুগণের প্রভাব ক্রিয়াশীল হোতে থাকে। তবে আশার কথা এই যে, বিরোচন-পূত্র বলি পুনরায় বলশালী হয়ে উঠলেও ত্রিবিক্রম-রূপধারী “বামন” সর্বদা তাঁকে পরাস্ত করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। এইভাবেই যুগ যুগ ধরে সবসময়েই দেবাসুরের সংগ্রাম হয়ে চলেছে।।

‘ *কথা প্রসঙ্গে* ‘ ২য় খণ্ড

*সমাপ্ত*