জিজ্ঞাসু –আপনি মধ্যমগ্রাম বা রায়নায় থাকাকালীন বিভিন্ন ঘটনার কথা সেদিন বলছিলেন। ক্যাম্পলাইফ থেকে আশ্রমে কিভাবে এলেন— এটা যদি একটু বলেন ?

গুরুমহারাজ—ক্যাম্পে থাকাকালীনই তো এই মিশনের জন্য নির্দিষ্ট বিভিন্ন ছেলেদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়ে গেল। তৃষাণ-এর সঙ্গে আলাপ হবার পর তো ও আর আমার সঙ্গ ছাড়েনি। কর্মোপলক্ষ্যে যখন আমি বিভিন্ন জায়গায় গেছি, তখন তৃষাণই একমাত্র ব্যক্তি, যে আমি কখন কোথায় আছি তা জানতো। ফলে সেই সময় যারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইতো, তারা আগে তৃষাণের সঙ্গে যোগাযোগ করত।

রায়নার জগাদার সঙ্গে ওর আত্মীয়সূত্রে বাঁকুড়ার চারিগ্রামে গিয়ে দেখি সেই বাড়ীতে মায়ের কৃপা যেন ঝরে পড়ছে। মনে মনে ভাবলাম কে থাকেরে এখানে ! তারপর দেখলাম মুরারীকে। মুরারী জন্ম থেকেই সাধু। ও সাধুদেরও সাধু। মুরারীকে দেখবে নীরবে সব কাজ করছে—কোন চাহিদা নেই, কোন অভিযোগ নেই, কোন
বিরক্তি নেই। এই জন্যই ওর নাম নিষ্কামানন্দ। ওর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য—ও যে কোন কাজ করে দেবে—ছোটকাজ বা নোংরাকাজ ওর কাছে কোন সমস্যা হয় না। শম্ভু (সত্যানন্দ), মানিক (অখণ্ডানন্দ), খোকন (আত্মানন্দ) এরাও তখন যোগাযোগ রাখত। ওরা গেলে সারারাত আলোচনা চলতো। এইভাবেই সকলকে নিয়ে আশ্রম করার পরিকল্পনার কথা আমি পূর্বেই বলেছিলাম। কিন্তু কোথায় হবে, কখন হবে—সে সম্বন্ধে কিছু বলিনি।

তৃষাণের সঙ্গে যোগাযোগ হবার পর ওই আমাকে দেবীবাবুর সঙ্গে পরিচয় করায়। দেবীবাবুর ওখানে হরি (সহজানন্দ), দীপ্তি (ভূমানন্দ), রেবা (মোক্ষপ্রাণা), তপি (পবিত্রপ্রাণা) এদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারপর ওদের বাড়ীর সকলের আমন্ত্রণক্রমে একদিন দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে মেমারী থেকে বনগ্রামে আসি। এখানে এসে আমি ন’কাকা (শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী)- কে দেখি । মুখার্জী বাড়ির কালীমন্দিরে বসামাত্রই আমি ভাবস্থ হয়ে যাই। দেখি ওখানে প্রায় ১০ হাজার বছর ধরে বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন মূর্তিতে শক্তির পূজা হয়ে চলেছে। কত মহাপুরুষ যুগ যুগ ধরে এখানে এসেছেন। বড় পবিত্র ভূমি ! ন’কাকাকে দেখলাম একজন মহাসাধক ! মা-কে ছোটবেলা থেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন। এখানে মা বালিকামূৰ্ত্তিতে বিরাজমানা। সেইজন্য আমি ঐ বাড়ির অন্যান্য কাকাদের বলেছিলাম বাড়িতে ছোট মেয়ে থাকলে যেমন বাবা হাতে করে কিছু নিয়ে এলে মেয়ে প্রসন্ন হয়, তেমনি মায়ের জন্য কিছু হাতে করে আনলে মা প্রসন্ন হবেন। মায়ের এখানে বালিকাভাব, মা এখানে করুণাময়ীরূপে রয়েছেন।

প্রথমবার বনগ্রাম আসার পরই মোটামুটিভাবে আশ্রমের স্থান নির্দিষ্ট হয়ে যায় কিন্তু আমি কাউকে কিছু বলিনি শুধু সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। কারণ আমি জানি কাল প্রসন্ন না হলে কোন কিছুই হবার নয়। তারপর ১৯৭৮ খ্রীষ্টাব্দে বনগামের ন’কাকা সহ মুখার্জী ও গাঙ্গুলীবাড়ির সকলে এবং ঐ গ্রামের অন্যান্য অনেক ভক্তগণ গ্রামে আমাকে কেন্দ্র করে একটা আশ্রম করার ইচ্ছাপোষণ করলে আর এমতাবস্থায় শ্রীযুক্ত স্বপন গোস্বামী তাঁর মায়ের নামে পাঁচ কাঠা জমিতে আশ্রম স্থাপনের প্রস্তাব দিলে তৃষাণের কথামতো ন’কাকা আমাকে চিঠি দিয়ে বনগামে আশ্রম করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তখন আমি পত্রে ন’কাকাকে জানাই—তাঁদের মনে যখন আশ্রম করার ভাবনা এসেছে, তখন নিশ্চয় ঠাকুরের কোন উদ্দেশ্য আছে। তাই গ্রামের বাইরে মাটির তৈরী একটা আশ্রয় বা কুঠিয়ার ব্যবস্থা করতে। তারপর আমার এই নির্দেশ পেয়ে তৃষাণ ন’কাকা সহ গ্রামের উৎসাহী উদ্যোগী মানুষদের নিয়ে স্বপনখুড়োর মায়ের দেওয়া জমিতে একটা ছিটেবেড়ার কুঠিয়া তৈরী করতে লেগে যায়। কুঠিয়া সম্পূর্ণ হবার আগে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় সারা পশ্চিমবঙ্গ প্লাবিত হয় এবং খুব ক্ষয়-ক্ষতি হয়। আমি তখন দামোদরের তীরে চক্ষণজাদীতে টগরদের বাড়িতে । ওখানে দামোদরের বাঁধ ভেঙে মানুষের কি চরম দুর্গতি ! টগরদের বাড়িটা ভগবানের কৃপায় আশ্চর্যভাবে রক্ষা পেয়ে গেল। আমার মাথা থেকে তখন আশ্রম করার চিন্তা উবে গেল। আমি আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে তখন বন্যাদুর্গতদের সেবায় মেতে গেলাম। বহু মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয়েছে, সবাই ক্ষুধার্ত। আমরা সকলে মিলে রুটি তৈরী করছি আর তাদের মধ্যে বিলি করছি। প্রথমে দেওয়া হোল শিশু ও বৃদ্ধদের, তারপর গর্ভবতী বা সন্তানবতী মায়েদের, তারপর পূর্ণবয়স্ক বড়দের। তখন দেখেছিলাম ক্ষুধা কি ভয়ানক জিনিস ! ক্ষুধার্ত পিতা বা মাতা সন্তানের জন্য বরাদ্দ রুটি নিয়ে গিয়ে তাতেই ভাগ বসাচ্ছে। ঐ সময় তৃষাণ বহু কষ্টে জল পেরিয়ে চক্ষণজাদীতে আমার সঙ্গে দেখা করতে ও আশ্রম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে যায়। তখন আমি ওকে বলি ইষ্টদেবীর আদেশ হয়েছে, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন আশ্রম প্রতিষ্ঠা হবে। তৃষাণের অনুরোধ সত্ত্বেও সেবার মানুষের দুর্গতি দেখে আমি দুর্গাপূজার উৎসবে বনগ্রামে আসিনি। তবে তৃষাণকে বলি আমি ওখান থেকে রায়নায় যাবো এবং রায়না থেকে আশ্রম প্রতিষ্ঠার ২দিন আগে বনগ্রাম যাবো।

বন্যা কিছুটা কমার পর আমি ওখান থেকে রায়না চলে গেলাম, ওখানে থাকাকালীন দুর্গাপূজার পর তৃষাণ গিয়ে হাজির। বনগ্রামেও বন্যার জল উঠেছিল। ওদের তৈরী কুঁড়েঘরটি বন্যার জলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ওরা সেটিকে repair করে আবার ready করে ফেলে। তাই তৃষাণ আমাকে নিয়ে যাবার জন্য এসেছিল। যাইহোক ওখান থেকে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার আগের দিন তৃষাণের সঙ্গে বনগ্রামে ন’কাকাদের বাড়িতে এসে উঠি। পরদিন অর্থাৎ কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদা মা ও স্বামী বিবেকানন্দের পূজার মাধ্যমে ভাবগম্ভীর পরিবেশে এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়। এইভাবেই বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের সূচনা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিনে।