জিজ্ঞাসু – আপনি কথা বলতে বলতে চুপচাপ হয়ে যান কেন ?

গুরুমহারাজ – আনন্দে। আলোচনার সময় প্রসঙ্গ যেই একটি স্তরে এসে পৌঁছায় বা জিজ্ঞাসাকারী যদি কোন উচ্চতত্ত্ব সম্বন্ধে ধারণা নিয়ে জিজ্ঞাসা করে বসেন – তখন আলোচনা শুরু হতেই আমার মস্তিষ্ক থেকে একপ্রকার অমৃতরস নিঃসৃত হয়, যা মস্তিষ্ককে cover করে বাকশক্তিকে রুদ্ধ করে দেয়। এ এক পারমার্থিক রমণের অবস্থা—সাধারণ রমণেই দেখা যায় শরীরের অন্যান্য অঙ্গ ক্রিয়াশীল থাকলেও বাকশক্তি মুহূর্তের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়—এক্ষেত্রে সেই রমণের চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ বেশী আনন্দ। সুতরাং আমার কথা বন্ধ হয়ে যায়, শুধু এক অব্যক্ত আনন্দের আস্বাদন ছাড়া অন্য কোন অনুভূতি থাকে না। তবে এই সময় আমার শরীর থেকে আনন্দের তরঙ্গ চতুর্দিকে প্রবাহিত হতে থাকে, যদি আমার কাছাকাছি কোন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি উপস্থিত থাকেন তিনি এটা অনুভব করতে পারবেন। হয়তো তাঁর শরীরে কম্পন, পুলক ইত্যাদির লক্ষণ দেখা দেবে। যাইহোক এই সময় আমার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ কিন্তু ক্রিয়াশীল থাকে বা চেতনা বিলুপ্ত হয় না। তাই ঐ মুহূর্তে আমি কোন পার্থিব জিনিস গ্রহণ করি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য। দেখবে ঐ সময় আমি হয়তো পকেট হাতড়ে সিগারেট ধরাই কিংবা কাউকে ইঙ্গিতে জল বা চা দিতে বলি। এগুলো গ্রহণ করলেই মন আবার হু হু করে নীচে নেমে আসে এবং আবার আমি আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতে পারি। এরকমই কোন সময় হয়তো তুমি আমাকে দেখেছ।

জিজ্ঞাসু—আপনার ঐ অবস্থার আনন্দ -তরঙ্গ আমরা অনুভব করতে পারি না কেন ?

গুরুমহারাজ—আধারকে উন্নত করতে পারোনি বলে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন — সাধারণ মানুষ মল-মূত্রের বেগ ধারণ করতে পারে না তো আধ্যাত্মিক বেগ ধারণ করবে কি করে ? যে আধার পারমার্থিক সত্তার প্রকাশে সক্ষম, সেই আধার তৈরী করতেই তো সাধনা। আর তা করার জন্য সচেষ্ট না হয়ে মানুষ তার আধারটিকে কি অন্যায়ভাবেই না ব্যবহার করে থাকে ! আধাররূপ দেহ-মন-অন্তঃকরণকেই তো মন্দির বলা হয়েছে। মন্দির যদি পবিত্র না থাকে, নোংরা পাপনিবাস হয়, তাহলে কি লোকে সেটাকে ভক্তি করে, না সেখানে দেবতার অধিষ্ঠান হয় ? সেইরূপ দেহ-মন্দির হ’ল অন্তরাত্মার আধার। প্রত্যেক জীবের যে শিবত্ব তার প্রকাশ ঘটে পবিত্র-হৃদয়ে, পবিত্র দেহ-মন্দিরে। যে ব্যক্তি যত পবিত্র তার মধ্যে পরমেশ্বরের তত প্রকাশ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ময়লা কাঁচ দিয়ে সূর্যকেও দেখা যায় না, কাঁচ যত পরিষ্কার হবে সূর্য ততই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতররূপে দেখা যাবে। তাই প্রথমেই মনের ময়লা পরিষ্কারের কাজে ব্রতী হতে হবে। মন নির্মল হলেই দেহ-রূপ আধারও নির্মল হবে আর নির্মল আধারে পরমেশ্বরের লীলারসের আস্বাদন হবে।

তবে এটা অবশ্য ঠিক—কোন মহাপুরুষ ইচ্ছামাত্র কাউকে ক্ষণিকের জন্য এই রস-আস্বাদন করাতে পারেন। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য কারণ অনুপযুক্ত আধার ঐ প্রচণ্ড বেগ ধারণ করতে পারে না, শরীরপাত হয়ে যেতে পারে অথবা পাগল হয়ে যেতে পারে। ঠাকুরের একটি কথা আছে—কুঁড়ে ঘরে হাতি ঢোকা অর্থাৎ পাগলা হাতি কুঁড়ে ঘরে ঢুকলে যেমন ঘরের অবস্থা হয় এখানেও সেরূপ। আমাদের সব্য হিমাচল প্রদেশে একবার খুব করে ধরেছিল, আমি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও যখন ও শুনল না তখন ওকে touch দেওয়া হয়েছিল। তারপর ওর শরীরের কি অবস্থা ! পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসার পরও জিজ্ঞাসা করেছিল – ‘কেন এমন হোল ?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘আধার অপ্রস্তুত।’

তাহলে বোঝা যাচ্ছে – উন্নত আধারই পারে উন্নত চিন্তা- তরঙ্গসমূহকে ধারণ করতে। তাই দেহে-মনে উন্নত হও, পবিত্র হও, তাহলেই পারমার্থিক আনন্দ-গ্রহণের অধিকারী হবে।