জিজ্ঞাসু—আপনি তো বাইরে বিশেষ কিছু খান না – সেটা কি খাদ্যাখাদ্য বিচারের জন্য—না আপনার প্রয়োজন হয় না ?
গুরুমহারাজ—ঠিক তাই—প্রয়োজন হয় না। যেটুকু প্রয়োজন আমি সবসময় সেটুকুই গ্রহণ করি। আমার জীবনে এক-একটা পর্যায়ে এক-একরকম অবস্থা আসে কাজেই কোন বিশেষ নিয়ম বা অনুশাসন অথবা শৃঙ্খলা দিয়ে এগুলো বিচার করা যাবে না—এর মধ্যে যদি কোন শৃঙ্খলা থেকে থাকে তবে সেটাও Devine
আবার না থাকলে সেটাও Devine । তবে বর্তমানে দেখছি আমি যদি একদম খাদ্য গ্রহণ না করি তাহলেই আমার শরীরটা ভাল থাকছে। কিন্তু আমার ইচ্ছা শুনছে কে –আমি যখনই কোন ভক্তের বাড়ি যাই বা কোন আশ্রমে যাই, এবার সেখানে গিয়ে আমি যদি কিছুই না গ্রহণ করি—সেটা বাড়ির লোকের বা আশ্রমবাসীর কাছে চরম মনোকষ্টের কারণ হবে। ফলে কিছু না কিছু খাদ্য আমাকে গ্রহণ করতেই হয়।
তবে খাদ্যাখাদ্য বিচারের কথা যেটা বলছ ওটা আমার ক্ষেত্রে খাটবে না। কারণ আমি যা খেতে পারি বা খেয়েছি সেটার নাম শুনলে তোমাদের অনেকের এক্ষুনি ‘বমি আসবে। পুরুলিয়ায় একটি বাড়িতে পলুপোকা চিংড়ি মাছের মতো ভাজা করে খেতে দিয়েছিল, আরাম করে খেয়ে নিয়েছি। হিমালয়ে ঘোরার সময় ফল, মূল, পাতা, শ্যাওলা, ফলের খোসা কি না খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছি ! কুকুরের সঙ্গে ভাগ করে খাবার খেয়েছি। তবে একবার উত্তরভারতে একদল অঘোরাচারীর পাল্লায় পড়ে আধপোড়া নরমাংস খেতে হোত যাক্ ওটা জগদম্বার কৃপায় এড়ানো গেছে।
জিজ্ঞাসু—ঘটনাটা কি ঘটেছিল, যদি একবার বলেন ?
গুরুমহারাজ—ছোটবেলায় ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে আমি বিভিন্ন মত ও পথের সাধু-সন্তদের ক্রিয়া-কাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। দেখেছি তাদের মধ্যে বেশীরভাগই ভ্রান্ত বা ভ্রষ্ট আবার কাউকে কাউকে দেখেছি প্রকৃত আধ্যাত্মিক পথের পথিক। যাইহোক ঘুরতে ঘুরতে আমি একদল অঘোরপন্থী সাধুদের পাল্লায় পড়ে গেলাম। ওরা বিশেষ বিশেষ তিথি-নক্ষত্রে বিভিন্ন রকম অভিচার ক্রিয়া করত। আমার সঙ্গে যখন ওদের দেখা হ’ল, সেইসময় ঐরকমই একটা বিশেষ যোগ উপলক্ষ্যে ওরা সেটার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। প্রথমটায় ওরা আমার বয়স ছোট বলে পাত্তা দিতে চায়নি। কিন্তু সংস্কারহেতু বৈদিক জ্ঞান-কাও আমার জানা। ফলে কিছু কথাবার্তা হবার পর ওরা ভাবল আমি কোন অঘোরপন্থী সাধু— কায়াকল্প করে বালকশরীরে রয়েছি। ফলে ওরা আমাকে মণ্ডলেশ্বর বানিয়ে চক্র করার সিদ্ধান্ত নিল। আমি চুপচাপ ওদের কাণ্ড দেখে যাচ্ছি। রাত্রিবেলায় এক শ্মশানের ধারে নির্জন-জায়গায় ওরা সবাই গোল হয়ে বসল, তারপর সবার সামনে একটা করে নরকপালে মদ ঢেলে দেওয়া হোল। তখনই কে একজন কাপড় ঢাকা দিয়ে কিছু একটা নিয়ে এসে ওদের মাঝখানে রাখল। তখন বুঝতে পারিনি, পরে বুঝেছিলাম ওটা ছিল একটা আধপোড়া তরুণের মৃতদেহ। বোধহয় শ্মশানের ডোমের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন মন্ত্রোচ্চারণ ইত্যাদির পর সেটার ঢাকা খুলে ওদেরই একজন কেটে কেটে সবাইকে ভাগ করে দিতে লাগল। সবাই চোখ বুজে মদের ঘোরে ও মন্ত্রোচ্চারণে তন্ময়, সেই ফাঁকে আমি একবার আমার ভাগটা দেখে নিলাম—দেখলাম আমার ভাগে পড়েছে একটা আধপোড়া হাতের আঙুলসমেত একটা কব্জি। ওরা তো কেউ কেউ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কড়মড় করে চিবোতে লাগল আর আমি ভাবছি সর্বনাশ শেষে কি নরমাংস খাওয়ানোরই মা জগদম্বার ইচ্ছা নাকি ! একবার ভাবছি না খেয়ে উঠে যাই আবার ভাবছি ওরা যদি জানতে পারে তাহলে ওদের ক্রিয়া-কাণ্ডের প্রতি অসম্মান জানানোর জন্য হয়তো আমার উপর ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। কি করা যায় চিন্তা করছি, এমন সময় আমার পাশের বৃদ্ধ সাধুটি আমাকে ইঙ্গিতে বলল, ‘খেয়ে নাও’। আমিও তাকে ইঙ্গিতে বললাম, “তুমি খেয়ে নাও।” ওর নিজেরটা শেষ হয়ে গিয়েছিল, ফলে খুশি হয়ে সে আমার ভাগটা তুলে নিল। তারপর ঐটা দিয়ে বেদম মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে সবাই ভূমিশয্যা নিল। আমি দেখলাম ভোর হতে এখনও কিছু বাকি আছে, সেই সুযোগে স্থান ত্যাগ করলাম।
তাহলে বোঝ ব্যাপারটা, সেদিন কিন্তু আমার পাশের সাধুটি আমার ভাগটা তুলে না নিলে আমাকে নরমাংসই খেতে হত। ফলে খাদ্যাখাদ্য বিচার আমি করিনা, ওটা মা জগদম্বা করেন। তিনি আমাকে যখন যেখানে রাখেন আমি সেখানে থাকি, আবার যখন যা খাওয়ান তখন তাই খাই। নাহলে হিমালয়ে ঘোরার সময় নাঙা সাধুদের পাল্লায় পড়ে হয়তো মাসাধিক কাল কোন খাবার জোটেনি আবার যখন পেয়েছি হয়তো ৫/৭ জনের খাবার একাই খেয়ে নিয়েছি।
তবে আমি দেখেছি যে, শরীর রক্ষার জন্য যে শুধু স্থূল-খাদ্যেরই প্রয়োজন হয় তা নয়, অন্যভাবেও শরীর রক্ষা করা যায়। হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে এমন সাধু-সন্ন্যাসীরা আছেন যাঁরা সাধারণ মানুষ খাদ্য বলতে যা বোঝে—প্রায় তাঁরা তা গ্রহণই করেন না। তবে তাঁরাও খাদ্য গ্রহণ করেন কিন্তু অন্যরকম খাদ্য। তোমরা ‘পওহারী’ বাবার নাম শুনেছ —যাঁর সাথে স্বামীজীর দেখা হয়েছিল, তিনি শুধু বায়ু ভক্ষণ করে বেঁচে
থাকতেন। তেমনি আমি অনেককে দেখেছি যাঁরা শুধু সূর্যালোক থেকে সরাসরি শক্তি আহরণ করতে পারেন। সুতরাং শরীর ধারণের জন্য বিকল্প খাদ্য গ্রহণের কৌশল জানা থাকলে স্থূলখাদ্য গ্রহণের প্রয়োজনই বা কি ?