জিজ্ঞাসু—একটা গানে আছে “অজপা যদি ফুরায়”—তা অজপা ফুরাবে কেন—এটা তো চিরন্তন ?

গুরুমহারাজ—গান-টান খুব মন দিয়ে শোনা হয় দেখছি। দ্যাখো, প্রাকৃতিক নিয়ম তো মহাবিশ্বপ্রকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অজপা চিরন্তন বলছো কিন্তু সেটা তো এই সীমার মধ্যে অর্থাৎ সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের মধ্যেই তার কার্য্যকলাপ। সাধারণে এ রহস্য ধরতে পারেনা, সাধকেরা সাধনার একটা স্তরে উঠে এই রহস্য বুঝতে পারে। নাদ থেকে সৃষ্টি, নাদেই স্থিতি আবার নাদেই প্রলয় — একে অনাহত নাদ বলা হয়েছে। সাধকের অন্তঃপ্রকৃতিতে এটি অজপা-রূপে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু যেখানে সাধনা শেষ বা মনের লয় হচ্ছে অর্থাৎ সাধনার আর কোন বিকল্পের দরকার নেই, নির্বিকল্প স্থিতি লাভ হয়েছে তখন অন্য কিছুই তো নেই । তাই অজপাও নেই । তখন কে অজপা আর কারই বা অজপা ! কেই বা শোনে আর কেই বা সৃষ্টি করে। রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করলে ! এখানে অর্থাৎ গানে সাধক অজপার সন্ধান পেয়েছেন, কিন্তু তাতে তাঁর তৃপ্তি নেই। কালীসাধক অজপার কথা বলছেন, কৃষ্ণসাধক এটাকেই বাঁশীর সুর হিসাবে শুনতেন। বংশীর সুর শুনে কি মন ভরে, যদি বংশীধারীর সঙ্গে দেখা না হোল ! সুতরাং সাধক সাধনার পারে যেতে চান অর্থাৎ চরম বা পরম অবস্থা প্রাপ্ত হতে চান। এখানে গানের মাধ্যমে সাধক এই মনোভাবই প্রকাশ করতে চেয়েছেন।

জিজ্ঞাসু—আশ্রমে নানারকম ভক্তরা আসে, অনেকের ছেলে-মেয়েরা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন, ওরা কি ঠিক হয় না ?

গুরুমহারাজ — তুমি যেগুলো বলছ – ওগুলো crisis of pigmanto. ডাক্তারিবিদ্যায় ওদেরকে মোঙ্গল (Mongolied ) Child বলে। মোঙ্গলিয়ানদের মতো দেখতে হয় মুখের গঠন। গোটা ভারতবর্ষের যে কোন প্রান্তে যে কোন জাতির মধ্যে ঐটা দেখতে পাবে। ব্যাপারটা হচ্ছে—ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণ ঘটেছে, ফলে ভিন্ন ভিন্ন মুখের মানুষ এখানে দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু gene-এ original ধৰ্ম অপরিবর্তিত থেকে গেছে। যখনই কোন পিতামাতার মধ্যে বা সেই বংশের রক্তে এমন কিছু প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কাজ হয় যা nature আর accept করে না তখন তার genetic ধারা ব্যাহত হয়ে original-a ফিরে যায় অর্থাৎ প্রকৃতি withdraw করে নেয় বা বলা যায় ঐ বংশগতি বন্ধ হয়ে যাবার নির্দেশ দেয়। এরকমভাবে সমাজে দেখবে, যে সমস্ত পরিবারে পুরুষরা অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করেছে বা করছে, কয়েক generation-এর মধ্যেই সেই পরিবারে হয় সন্তান আসবে না অথবা সন্তান কঠিন ব্যাধিগ্রস্ত হবে বা তার অকালমৃত্যু হয়ে যাবে। হয়তো কন্যারা বেঁচে থাকল – পুত্রসন্তান থাকল না। অর্থাৎ প্রকৃতি ঐ পরিবারের ধারাকে আর সমাজে টিকিয়ে রাখতে চাইছে না, বা থাকলে আরও খারাপ হবে। এইভাবে প্রকৃতি বহু জেনেটিক ধারাকে with draw করে নেয় বলেই সমাজে এখনও অনেকটা সাম্যভাব দেখতে পাচ্ছ আর নাহলে এক-একটা মানবগোষ্ঠী কবেই শেষ হয়ে যেতো।

আর রোগসারার যে ব্যাপারটা বলছ – সেটা বলছি শোনো, মানবশরীরকে কেন্দ্র করে তিনরকম রোগ হয় আধি, ব্যাধি ও উপাধি। আধি হচ্ছে ব্যাধির কারণ, যা সূক্ষ্মশরীরকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ মনোজগতে মনঃকুওয়নরূপে প্রথমে সৃষ্টি হয়। অনেক পরে তা নানান ব্যাধিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ব্যাধির ঔষধ হচ্ছে তিনপ্রকার ঔষধি, রসায়ন ও প্রাণায়াম। Acute desease অর্থাৎ Life cell যখন আক্রান্ত হয় তখন সেই রোগ নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন হয় ঔষধি। আয়ুর্বেদবিজ্ঞান এবং বর্তমান অ্যালোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি ঔষধ এর মধ্যে পড়ে। ক্রনিক ডিজিজ বা জেনেটিক ডিজিজ সারে রসায়নে অর্থাৎ কিছু হোমিও এবং বায়োকেমিক ঔষধে। কিন্তু নিউরোসেল-এর রোগে কোন মেডিসিন কাজ করে না। এটা সারাতে গেলে প্রয়োজন হবে প্রাণায়ামের। গোটাকয়েক মন্ত্র উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে যদি প্রাণায়াম করা যায় তাহলেই এই ব্যাধি সারবে—অন্যথায় নয়। এইভাবে আয়ুর্বেদিক বিধান অনুযায়ী চললে মানুষের দেহ ও মন সুস্থ
থাকে। কিন্তু চিত্তের চিত্তধর্ম থেকে যায়। হোমিওপ্যাথিকের জনক হ্যানিম্যান বলল – জাতক সুস্থ মন নিয়ে জন্মায় —এটা ভুল। এক-একজন মানুষ পৃথক পৃথক সংস্কার নিয়ে জন্মায়। ঐ সংস্কার জন্মাবার সময় প্রত্যেকের চিত্তে সুপ্ত থাকে। এগুলি বিভিন্ন বৃত্তিরূপে পরে পরে আত্মপ্রকাশ করে, যেমন মনোবৃত্তি, বুদ্ধিবৃত্তি, অহংবৃত্তি ইত্যাদি। জাতকের উপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে আজকাল। আমরা লক্ষ্য করেছি পরিবেশের প্রভাব রয়েছে কিন্তু শুধু পরিবেশের প্রভাব সাময়িক ফল দেয়। যেমন কোন জাতকের হয়তো কুপরিবেশের প্রভাবে তার মধ্যে অশুভ গুণ প্রকট হয়েছে কিন্তু তার মধ্যে যে শুভ গুণ রয়েছে তা ভাল পরিবেশে – যে কোন সময়ে প্রকট হতে পারে। এই ভাবে রত্নাকর বাল্মীকি হতে পারে—আশ্চর্য হবার কিছু নেই আবার মহিষও মহর্ষি হতে পারে। সম্ভাবনা সব সময় রয়েছে আর সম্ভাবনা আছে বলেই তো উৎক্রমণ—বিজ্ঞান তো এটাই বলছে আজকাল।