জিজ্ঞাসু—গুরুমহারাজ ! প্রাণায়াম মানে কি ক্রিয়াযোগ ?
গুরুমহারাজ—ক্রিয়াযোগ তো নিশ্চয়ই কিন্তু বর্তমানে ক্রিয়াযোগী বলতে অনেকেই শ্যামাচরণ লাহিড়ীর পরম্পরার মতাবলম্বীদের বোঝায় এবং ওরা এটাও প্রচার করে যে, ওদের দেওয়া ক্রিয়াযোগ অবলম্বন না করলে আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় না। এগুলো ঠিক নয়। যোগশাস্ত্র অনন্ত জ্ঞানভাণ্ডার। বাবাজী মহারাজ যুগ-প্রয়োজনে এর মধ্যে মাত্র ৫টি দিয়েছিলেন যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়কে। শ্যামাচরণ তাঁর শিষ্য যুক্তেশ্বর গিরিকে ৪টি দেয়। এখনও সেটাই চলছে। কিন্তু যুক্তেশ্বর গিরিজীর পর যোগানন্দ ইত্যাদিরা সন্ন্যাসী পরম্পরায় এবং পাশাপাশি আদ্যনাথ রায় ইত্যাদিরা গৃহী পরম্পরায় দীক্ষা দিয়ে চলেছে। বর্তমানে জনৈক ভট্টাচার্য ছিল কলকাতায়, তার শিষ্যরা এসেছিল আমার কাছে। বলল – ক্রিয়াযোগ ছাড়া কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ হবে না –আধ্যাত্মিক শক্তিলাভ হবে না। আমি ওনাদের জিজ্ঞাসা করলাম, ক্রিয়া বা কর্মে তো মানুষ ক্লান্ত হয় কিন্তু নিদ্রায় মানুষ সুস্থ হয় আবার কর্ম করার শক্তি ফিরে পায়, তাহলে ক্রিয়াযোগ না করে ঘুমানোই তো ভাল ? উত্তর দিতে পারল না। যোগবিজ্ঞানের রহস্যই জানে না—সে শিক্ষা নেই। সব পরম্পরাতেই এই রকম হয়। সদগুরু বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা যতক্ষণ ধরে থাকেন ততক্ষণ সব ঠিক থাকে, তারপর থেকেই শুধু বচন-সর্বস্বতা, কাজের কাজ কিছুই নেই। তবে তত্ত্ব না জেনেও বাবাজীমহারাজ- নির্দেশিত ক্রিয়াযোগ করে গেলে কাজ হয়—অস্বচ্ছ ধারণা নিয়েও এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু taste হয় না। সমুদ্রের ঢেউ পাখীর ডিম ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বলে পাখী দম্পতির ঠোঁটে করে সমুদ্রের জল ছেঁচে ফেলার যে চেষ্টা—সে প্রচেষ্টাতেও তো সমুদ্র-দেবতার কৃপা হয়—এটাও সেইরকম বলতে পারো।
মল, বিক্ষেপ ও আবরণ—তিন রকমের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রাণায়ামে মল দূর হয়— দেহ সুস্থ হয় কিন্তু বিক্ষেপ যায় না। রাবণ – হিরণ্যকশিপু কতবছর ধরে কত তপস্যা,সংযম, ব্রত পালন, প্রাণায়ামাদি করল—কিন্তু কি হল ! ঈশ্বরবিরোধী হল অর্থাৎ প্রকৃতি-বিরোধী হল – সমাজ এক শক্তিশালী অনাচারী, অত্যাচারী ব্যক্তিকে পেল। তাহলে প্রশ্ন এই বিক্ষেপ কিসে যায় ? – উপাসনায়। উপ অর্থে সামীপ্য, অর্থাৎ সদগুরুর সান্নিধ্যে তাঁর নির্দেশমতো সাধন-ভজন করতে হবে। এটাকেই বলা হচ্ছে বর্তমান সাধন। বর্তমান আর অনুমান। কল্পনায় কোন ঈশ্বর বা মূর্তিকে ধরে যে সাধন সেটাই অনুমান সাধন আর সদগুরুর কাছে সমিৎপাণি হয়ে তাঁর নির্দেশ পালন করাই বর্তমান সাধন। এবার আবরণ উন্মোচন হবে কি করে ? এখানে সাধকের কিছু হাত নেই, এখানে শুধু অপেক্ষা—কখন দরজা খুলবে ! ভিতর থেকে allow করলে তবেই ভিতরে প্রবেশের অধিকার—নাহলে শুধু অপেক্ষা, এই অবস্থায় অনেক যোগী বহুকাল রয়েছেন। কারও হয়তো ডাক পড়ল কিন্তু যাঁদের পড়ল না তাঁদের কোন আক্ষেপ নেই, কারণ তাঁরা বিক্ষেপমুক্ত।