জিজ্ঞাসু—নেশার বস্তু গ্রহণ করলেও এমনটা অনেক সময় হয় না কি ?
গুরুমহারাজ – হ্যাঁ, নেশা করে না বা নেশায় অভ্যস্ত নয়, এমন লোককে গাঁজা বা মদ একটু বেশী পরিমাণে খাইয়ে দিলে যদি তার কোষ্ঠ পরিষ্কার না থাকে, তাহলে পায়খানা করে ফেলবে। নেশার দ্রব্যের ক্রিয়াও সরাসরি মস্তিষ্কে হয়, তাই দেখবে মাথা তুলতে কষ্ট হচ্ছে আর মাথার balance থাকে না বলেই পা টলমল করছে। চণ্ডু খাইয়ে একটা সুস্থ লোককে পাগল করে দেওয়া যায়—পানের সঙ্গে মিশিয়ে এটা শত্রুতা করে অনেকে খাইয়ে দেয়। কচি তামাক পাতা ঘসে ঘসে তার রস থেকে চণ্ডু তৈরী হয়। এক কুইণ্টাল তামাক পাতা থেকে হয়তো ১০০ গ্রাম চও হবে। এই জন্যই চতুর খুব দাম। আমি বিভিন্ন নেশার দ্রব্য—চ, চরস, গাঁজা, তামাক, মদ সবই খেয়ে দেখেছি—শরীরের উপর কোন দ্রব্যের কিরকম ক্রিয়া হয়। গাঁজা যে খায় তার যদি ব্রহ্মচর্য না থাকে, তাহলে ক্ষতি হবে। T. B. কিংবা হাঁপানি হয়ে যাবে আর prostate gland-এর বারোটা বাজবে। এই জন্যই দেখবে সাধুরা গাঁজা খেয়েও ঠিক আছে, সাধন-ভজন করছে। বামদেব মদ খেয়েই সাধনা করেছিলেন, মাতৃদর্শন হয়েছিল। সেই দেখে অনেকেই তা করতে গিয়ে তারা মাতাল হয়ে যাচ্ছে—আসল তালটাই ভুলে যাচ্ছে। সব্য আমার সঙ্গে ১০/১২ দিন তারাপীঠ, বক্রেশ্বর, জয়দেব এই সমস্ত অঞ্চল ঘুরেছিল। জয়দেবে দেখেছিলাম গাঁজার ধূম। গাঁজার ধূম মানে গাঁজার ধোঁওয়া—এমন ধোঁওয়া যে, সেই স্থানে খানিকক্ষণ থাকলেই তোমার নেশা হয়ে যাবে। সব্যকে বলা ছিল যে, কোন সাধুর কাছে গেলে যেন আমার পরিচয়টা না দেয়। ওর দাড়ি-গোঁফ রয়েছে আর আমার মুখ পরিষ্কার, ফলে ওকে বললাম- -“তুমি মহারাজ বনে যাও আর আমি তোমার চেলা।’ ও ওসব খেতে পারে, আমি ready করে দিচ্ছিলাম ফলে সবাই তাই ভেবে নিল। কয়েকজন মহাত্মার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওখানে। তবে দেখলাম প্রকৃত সাধুরা একজন সাধুর কাছেই আধ্যাত্মিক কথা বলে, lay-man- এর কাছে ধরা দেয় না। ঠক বা ভেকধারী সাধুরা প্রকৃত সাধু দেখলে শঙ্কিত হয়, আর layman-এর কাছে বড়াই করে।
জিজ্ঞাসু—অবধূতের শিক্ষা সম্বন্ধে ‘রামকৃষ্ণ কথামৃতে’ উল্লেখ আছে—এটা কি ছিল ?
গুরুমহারাজ—‘অবধূত’ কথাটি সন্ন্যাস আশ্রমের একটা বিশেষ স্থিতি। অনেক ‘অবধূতে’-র কথা তুমি শুনে থাকবে। তবে শিব-অবতার বা শিব-স্থিতিতে থাকা অবধূতের মধ্যে আমরা পাই নিত্যানন্দ মহাপ্রভুকে । অবধূতাচার্য দত্তাত্রেয়কে যোগী সম্প্রদায় আদি হিসাবে মানে। উনি ২৪টি গুরুর কথা শিষ্যদের নিকট উল্লেখ করেছিলেন, যেমন—পঞ্চ মহাভূত, পঞ্চ তন্মাত্রা, আকাশ, সূর্য, চন্দ্র এছাড়াও কামার, ব্যাধ, চিল, মৌমাছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকের কাছে তিনি কোন না কোন বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছিলেন এবং তা তিনি তাঁর নিজের জীবনে যোজনা করে সুফল পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এগুলিকে বলার সময় গুরুরূপে উপস্থাপনা করেন। রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ এই পঞ্চ তন্মাত্রায় বিভিন্ন প্রাণীরা আকৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারায়। তিনি মানুষকে বিভিন্ন তন্মাত্রার ব্যাপারে সাবধান হতে শিখিয়েছিলেন। পৃথিবীর অপরিসীম সহ্য করার শক্তি তাঁকে অবাক করেছিল এবং তা তিনি জীবনে শিক্ষা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন মানুষ মল, মূত্র, আবর্জনা যা কিছু খারাপ —মাটিকে দেয় কিন্তু মাটি দেয় জীবনদায়ী ফসল—শস্য। জলকে তিনি দেখেছিলেন স্বচ্ছতার প্রতীক হিসাবে। কতকিছু তাকে অস্বচ্ছ করার চেষ্টা করে কিন্তু জল আবার স্বচ্ছ হয়— জল জীবন দান করে, জল জীবনে শান্তি দান করে—সাধু জলের মতো স্বচ্ছ হোক, পৃথিবীর মত সর্বংসহ হোক। তিনি অগ্নির নিকট শিখেছিলেন নির্বিকারত্ব অর্থাৎ অগ্নি সবকিছুকেই পোড়ায়—চন্দন কাঠকেও পোড়ায় আবার বিষ্ঠাকেও কিন্তু নিজে অবিকৃত থাকে। সাধু অগ্নির মতো নির্বিকার হোক। বাতাস সুস্থান কুস্থান সব স্থানের মধ্যে দিয়ে যায়, সুগন্ধ-কুগন্ধ সবকিছু গ্রহণ করে কিন্তু নিজে লিপ্ত হয় না। সাধু বাতাসের ন্যায় নির্লিপ্ত হোক। আকাশ উদার সবকিছুতে তার ছায়া পড়ে, কিন্তু কারও ছায়া আকাশে পড়ে না। সাধু আকাশের ন্যায় উদার হোক । সূর্য নির্বিশেষ। সবাইকে সমান আলো দেয়—সূর্যই সবাইকে প্রকাশিত করে কিন্তু কোন কিছুই সূর্যকে প্রকাশ করতে পারে না। সাধু সূর্যের ন্যায় নির্বিশেষ হোক। চন্দ্র কলায় কলায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় আবার কলায় কলায় হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। অতএব জগতে চিরন্তন কিছুই নয়, সবই বিনাশশীল এবং পুনরায় তার প্রকাশের বা বিকাশের সম্ভাবনা বিদ্যমান। অতএব সাধু জগতের সৌন্দর্য সম্বন্ধে সাবধান থাকবে কারণ তা চন্দ্রকলার ন্যায় ক্ষণস্থায়ী।
এইভাবে সকল সন্ন্যাসীর গুরুস্থানীয় অবধুতাচার্য দত্তাত্রেয়র শিক্ষা পরম্পরাগতভাবে সন্ন্যাসীরা মেনে চলার চেষ্টা করেন। এইগুলি ছাড়া কামারের কাছে তিনি শিখেছিলেন নিষ্ঠা। কারণ কামার একমনে তীর তৈরী করছে, বাদ্যি বাজিয়ে একদল বরযাত্রী পাশ দিয়ে চলে গেল, দেখেনি। তার কর্মের প্রতি এত নিষ্ঠা ছিল যে, কাজ শেষ না করে সে অন্য ব্যাপারে মন দেয়নি। যোগীর এই নিষ্ঠাই তাঁকে উত্তরণের পথে নিয়ে যায়। তিনি শিখেছিলেন ব্যাধের কাছে একাগ্রতার শিক্ষা। ব্যাধ জলাশয়ের তীরে তীক্ষ্ণ ফলা নিয়ে অপেক্ষা করছে একাগ্রচিত্তে, অনেকক্ষণ পর একটা মাছ এল আর সেটাকে গেঁথে ফেলল। যোগী শিখলেন একাগ্রতাই কৃতকার্যতার একমাত্র উপায়। চিলের কাছে শিখলেন—অশান্তির মূল ভোগ্য-বস্তুকে ত্যাগ করার শিক্ষা। একখণ্ড মাংস নিয়ে উড়তেই একপাল কাক কা-কা করে চিলটিকে উদ্ব্যস্ত করে তুলল। চিল গাছে বসতে পারছে না—নীচে নামতে পারছে না—উড়তে গেলে কাকেরা ঠোকর মারতে যাচ্ছে আর ক্রমাগত কা-কা করে বিরক্ত করছে। চিলটি মাংস- খণ্ডটি মুখ থেকে ফেলে দিল—কাকের দল চিলকে ছেড়ে মাংসখণ্ডের পিছনে ছুটল। চিল পরম নিশ্চিন্তে একজায়গায় বসে গা-চুলকাতে লাগল। যোগী শিখলেন কিভাবে ভোগের বাসনা ত্যাগ করে সমাজের মানুষের ঝামেলা এড়িয়ে নিজে শান্তি পাওয়া যায়। অবধৃত মৌমাছির কাছে শিখলেন সঞ্চয়ের কুফল। হাজার হাজার মৌমাছি লক্ষ লক্ষ ফুল থেকে এক রেণু, এক রেণু মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে সঞ্চয় করেছিল ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু তাদের সঞ্চয় সম্পূর্ণ হতেই একদিন একটি ভাল্লুক এসে মধুসমেত মৌচাকটি ভেঙে নিয়ে চলে গেল। হাজার হাজার মৌমাছির সে কি আপশোস ! সাধু বুঝলেন সঞ্চয়ে বৃথা কালক্ষয় হয়। আর সাধুর জীবনে সঞ্চয়ই অশান্তির কারণ।
এইতো অনেকগুলো বলে ফেললাম, প্রার্থনার সময় হয়ে গেল, এখন এই পর্যন্ত থাক।