জিজ্ঞাসু- -বাবা! গয়া থেকে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন ?
গুরুমহারাজ—ওখান থেকে গিয়েছিলাম বৃন্দাবনে। বন্ধুবিহারী বা বাঁকাবিহারী মন্দিরে ঝাঁকিদর্শন উপলক্ষ্যে প্রচণ্ড ভিড়। আমিও সেই ভিড়ে সামিল হয়ে গেলাম। ওখানে সবাই মাথায় ঝাঁকায় করে পূজা নিয়ে যায় আর মন্দির প্রাঙ্গণে অনেককে একসঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়ে হঠাৎ করে পর্দা একবার তুলে দিয়ে বিগ্রহ দেখায়। তারপর আবার পর্দা নামিয়ে দেয়। ফলে মন্দির-প্রাঙ্গণে খুবই ভিড় আর হুড়োহুড়ি। একজন হুড়মুড় করে ঢুকে আমার পা মাড়িয়ে দিল। আমার খুবই ব্যথা লাগল, রাগের চোটে আমি বলে উঠলাম, “অন্ধ হ্যায় কিয়া ?” চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম সুরদাস – (হিন্দিতে অন্ধকে সুরদাস বলে)। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি তো অন্ধ, কি দেখতে এসেছ ?’ ও বলল, ‘দেখনে কে লিয়ে নেহি, দিখানে কে লিয়ে আয়া।’ সেকথা শুনেই আমার শরীরে সে কি জ্বালা শুরু হ’ল। অসহ্য জ্বালায় অস্থির হয়ে ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে এলাম, যমুনার তীরে। জলে নেমেও জ্বালা থামে না, এরকম অবস্থা দেড় মাস ছিল। তারপর একদিন বৃন্দাবনের প্রেম অনুভূত হল যমুনার তীরে। সে এক অপার্থিব অনুভূতি ! তারপর বৃন্দাবন ঘুরতে লাগলাম। এক বড় বৈষ্ণব আশ্রমের সাধুবাবার সাথে আলাপ হ’ল। অনেক আয় আশ্রমের— আমি দশ টাকা চাইলাম, দিল না। বলল, ‘বাপকা আমানত রাখা হ্যায় কিয়া !” বাইরে আসতেই এক জীর্ণ কুটিরে এক পাগলা সাধুবাবার কাছে গেলাম । খুব আদর করল—খাওয়াল। দেখলাম প্রকৃত সাধুই একজন সাধুর আপনজন। মায়ের মতো স্নেহ-ভালোবাসায় কয়েকদিন রাখল। তারপর ওখান থেকেও বিদায় নিয়ে চলে এলাম ।
যাইহোক দেখলাম শান্তি বা আনন্দ যা কিছু আছে—তা যোগী বা ধ্যানীর কাছে, জ্ঞানীর কাছে ও প্রেমীর কাছে। তুমি সংসারে থাকলে ক্লেশ তোমাকে স্পর্শ করবেই। যদি তোমার নিজের ক্লেশ না থাকে অপরের দুঃখ-কষ্টেও তোমার ক্লেশ হবে। কিন্তু একমাত্র তুমি যদি বুদ্ধের কাছে থাক, প্রেমীর কাছে থাক – তাহলে তা তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এই যে তোমরা এখানে আছ, সংসারে কত ক্লেশ ভোগ কর —কিন্তু আশ্রমে শান্তি পাও। অনেকে এখানে এসে শুধু ঘুমায়—বাড়ীতে নানান চিন্তায় হয়তো ভাল করে ঘুমাতে পারে না। অনেকে দেখি সিটিং-এ ঘুমিয়ে গেল। অন্য লোক বিরক্ত হয় নাক ডাকছে বলে, আমি বলি আহা ঘুমাক না ! Disturb কোরো না। যাইহোক এইভাবে নানান ঘটনার অভিজ্ঞতায় বোধ করেছি ধ্যানে, জ্ঞানে এবং প্রেমেই আনন্দ।
.জিজ্ঞাসু — ধ্যানের পথ, জ্ঞানের পথ এবং প্রেমের পথ—এই তিনটির মধ্যে আমার প্রকৃতি অনুযায়ী কোনটি উপযুক্ত তা কি করে বুঝব ?
গুরুমহারাজ— ঠিকই বুঝতে পারবে—এতকিছু বুঝতে পারছ, আর ঐটা বুঝতে পারবে না ? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন— বধূটির সঙ্গে শ্বশুর, দেওর, ভাশুর সবার সম্বন্ধ কিন্তু স্বামীর সাথে সবার সাক্ষাতে একরকম ভাব আবার গোপনে অন্য ভাব, যেটা কারুর সাথে মেলে না। বা অন্য কারুর সাথে সে ভাব হয় না। এখানে বধূ যেন সাধক আর স্বামী ইষ্ট। ইষ্টের সাথে যে ভাব আরোপ করে সাধনপথে দ্রুত উন্নতি হয় সেটাই একজনের প্রকৃতি। আপন বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেই এগিয়ে চলতে হয়। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এটাকেই বলেছেন—’স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ’।
জিজ্ঞাসু—‘অধ্যাত্মবিজ্ঞান’ বলতে কি বোঝায় ?
গুরুমহারাজ—যেমন জড়কে জানতে জড়বিজ্ঞান, জীবকে জানতে জীবনবিজ্ঞান, মনকে জানতে
মনোবিজ্ঞান, তেমনি অধ্যাত্ম বিষয়ে জ্ঞানলাভ করতে গেলে জানতে হয় অধ্যাত্মবিজ্ঞান। এতক্ষণ তো অধ্যাত্মবিজ্ঞান নিয়েই কথা হচ্ছে। বলছিলাম না – স্ব স্ব প্রকৃতিকে অবলম্বন করে বা আপন আপন বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেই চেতনার উত্তরণ ঘটাতে হয় । এখানে কেউ কাউকে অনুকরণ করতে পারে না আর তা করলেও কোন লাভ হয় না বরং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উল্টো ফল হয়। বর্তমান যুগে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন অধ্যাত্মবিজ্ঞানী। সাধারণ মানুষ হয়তো জানে না তাঁর কথা কিন্তু হিমালয়ের বড় বড় সাধকেরা জানেন, কারণ ঠাকুর সেখানকার হাজার বছরের সঞ্চিত ভাবরাশিকে আশ্রয় করেই শরীর নিয়েছিলেন। তারপর সেই ভাবরাশিকে synthesis করে আবার তা সংসারে ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন। সাধারণ মানুষ কখনই ঐ positive field- এর সন্ধান পেতো না কিন্তু ঠাকুর করুণাবশত এটা করে গেলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কোন নতুন ধর্মমত সৃষ্টি করে যাননি। কবীর, নানক এঁরাও mystic ছিলেন কিন্তু সম্প্রদায় সৃষ্টি করলেন আর ঠাকুর সমস্ত সম্প্রদায়ের synthesis করলেন। যাঁরা এটা করেন তাঁরাই প্রকৃত অধ্যাত্মবিজ্ঞানী।