জিজ্ঞাসু—ধ্যানী, জ্ঞানী এবং ভক্তের আচরণের লক্ষণ কি ?

গুরুমহারাজ—যোগী বা ধ্যানীর নিষ্ঠা অর্থাৎ সাধনায় অবিচল নিষ্ঠাই ধ্যানীর লক্ষণ। জ্ঞানী হবেন অনাসক্ত আর সদাসর্বদা নিত্যানিত্য বিচারপরায়ণ। বিচারের ধারে জাগতিক অনিত্য বিষয়সমূহের প্রতি মোহ বা আসক্তি কচাকচ কেটে যায়। এবার এ দুটো যার মধ্যে নেই, তার চোখের জল ভরসা করে ভগবৎ নাম-স্মরণাদি ও তাঁর শরণাগত হয়ে থাকতে হবে। এটাকেই সাধারণত ভক্তি বলা হয়। কিন্তু পরাভক্তি আলাদা, জাগতিক দৃষ্টি নিয়ে পরাভক্তির ধারণা হওয়া মুশকিল।

জিজ্ঞাসু—জগৎ-সংসার নিয়ে যে স্বপ্ন দেখা বা কল্পনা করা, এগুলো কি ঠিক নয় ?

গুরুমহারাজ— দ্যাখো, আমি এই জগৎ-সংসার নিয়ে কখনও স্বপ্ন দেখিনা। তবে কল্পনা করি। মনে নানান ভাবনার উদয় হয় কিন্তু কখনও সেগুলো হতে বা পেতে ইচ্ছা করি না। কল্পনাকেও উপভোগ করা যায়, এ এক ধরণের enjoyment. তখন আমি কবিতা লিখি। মানুষ স্বপ্ন দেখে, কল্পনা করে আর সে তাই হতে ইচ্ছা করে বা কল্পনার বস্তুসমূহকে পেতে ইচ্ছা করে। জীব-স্বভাব আর শিব-স্বভাব। শিবের কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার নেই। তাই সমস্ত ঐশ্বর্য তাঁর করায়ত্ত। স্বয়ং অন্নপূর্ণা যাঁর স্ত্রী, তিনি শ্মশানবাসী, পশুচর্ম তাঁর বস্ত্র, ভূমি তাঁর শয্যা। এক-এক সময় আমারও মনে প্রশ্ন জাগে সহজতাই তো জীবের ধর্ম, তাহলে মানুষ কেন সহজ না হয়ে এত অসহজ, এত জটিল ? উত্তর পাই—এই বিশ্বসংসার কালীর নৃত্য, কালীর খেলা। শিবের বুকে কালীর নৃত্য হয়ে চলেছে। এইজন্যই দেখবে—শান্ত, সমাহিত শিবের বুকে নৃত্যরতা বা গতিশীল কালীমূর্তি তৈরী করা হয়। শিব Static — নির্গুণ ব্রহ্মের প্রতীক আর কালী Dynamic — সচল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের, শক্তির প্রতীক।

যাইহোক যা বলছিলাম, এই বিশ্বসংসার যেন শিবের বুকে কালীর নৃত্য—কালীর খেলা। তবে এখানে কালী নাচছেন শিবের চোখের দিকে তাকিয়ে—শিবের ভাল লাগছে কিনা সেটা দেখছেন। শিবের ভাল লাগছে তাই নির্দিষ্ট ছন্দে কালী নেচে চলেছেন। কালীর এই নাচের ফলে জগতে সু ও কু দুই হচ্ছে। তবে কি হচ্ছে তাতে কিছু এসে যায় না কালীর। শিব প্রশান্ত আছেন এটাই শেষ কথা। এবার নাচতে নাচতে যদি কালী দেখেন শিব যেন কেমন অপ্রসন্ন—ভ্রু কোঁচকাচ্ছেন, কালী নাচের ছন্দ বদলে দেবেন। পুরাতন ছন্দকে withdraw করে নেবেন। এরফলে জগতে বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রলয় হয়ে যেতে পারে, তাতেও কিছু এসে যায় না। মানুষ কালীর এই রূপকেই সংহাররূপা, ভীষণা ইত্যাদি বলে বর্ণনা করেছে। কিন্তু কালীর কাজ শিবের প্রসন্নতা অর্জন, তাই ছন্দবদল – সেটাও যদি পছন্দ না হয় আবার বদলে দেবেন। এইভাবেই হয়ে চলেছে যুগ থেকে যুগে, কাল থেকে কালে কালীর নাচন। শিবের interest আছে —তাই কালী খেলছেন—নাচছেন। আবার শিবের interest নেই তো কালী মুহূর্তে সে খেলাঘর ভেঙে দিচ্ছেন। তাই মহাসাধক গান গেয়েছেন, ‘জীব যেন পুতুল নাচের পুতুল।’ এই খেলায় বা নাচে কালীরও inte- rest রয়েছে—সেটা শুধুই শিবের প্রসন্নতার জন্য। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এইভাবেই শিব-শক্তির খেলা নিরন্তর হয়ে চলেছে। প্রতিটি জীবের মধ্যে, অণু-পরমাণুর মধ্যে, মানুষের মধ্যে এই একই তত্ত্ব বিদ্যমান। একই খেলা হয়ে চলেছে। শক্তি খেলা করে চলেছে। শিব নির্গুণ শান্ত সমাহিত হয়ে শুধু enjoy করে চলেছেন।