জিজ্ঞাসু – আপনি বলেছিলেন আপনার চলা খুব fast, এটা কি করে হয় ?
গুরুমহারাজ—যোগবিজ্ঞান যিনি জানেন, তাঁর অনেক কিছুই করায়ত্ত হয়। বহু যোগী আছেন তাঁরা ইচ্ছামত শরীরকে হাল্কা করে নিয়ে জল, কাদার উপর দিয়ে চলে যেতে পারেন। অনেকে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় বহুক্ষণ থাকতে পারেন। বরদাচরণ ছিলেন এরকমই একজন যোগী, যিনি বহুক্ষণ আসনে বসে থাকলে gravitationless হয়ে যেতেন। উনি মুর্শিদাবাদের লালগোলার ওখানে মাস্টারি করতেন—অনেকে এ ঘটনা নিজের চোখে দেখেছিলেন। উনি তৎকালীন বিপ্লবীদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করতেন আর যোগ-কৌশল শিখিয়ে দিতেন। দ্যাখোনা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের steel nerve ! ফাঁসির দড়ি পরতে যাচ্ছে হাসিমুখে, বীরদর্পে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি দিতে দিতে—ভাবা যায় ! এটা কাপুরুষের কর্ম নয়, বিপ্লবীদের মনের অবস্থা এই জায়গায় পৌঁছে দিতে বরদাচরণের ভূমিকা ছিল।
তবে সাধারণত পায়ের গোড়ালি পেতে যারা চলে, তারা উচ্চচিন্তার অধিকারী। এমন যদি কাউকে দেখো, তাহলে জানবে যে, সাধারণ নয়। এরা যে সবসময় সাধু-সন্ন্যাসী হবে তা হয়তো নয়—ি —কিন্তু এরা অন্য জগতের লোক। আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে এদের মেলাতে পারবে না। পুরো পা পেতে চলছে – জানবে ভোগী। ঘোর সংসারী হবে।
জিজ্ঞাসু –আচ্ছা মহারাজ ! Akbar the Great বলা হচ্ছে, আকবর কি সত্যিই মহান সম্রাট ছিলেন ?
গুরুমহারাজ—এই কথাটা অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে । কিন্তু আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, তোমার সাধারণ বুদ্ধি কি বলে ? আকবর বা যে কোন মোঘল সম্রাট তো originally মোঙ্গল। যারা ২/৪ পুরুষ আগেই ছিল মরুদস্যু। এদের ছিল ভ্রাম্যমাণ জীবন আর মাঝে মাঝে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে আচমকা লুঠতরাজ চালিয়ে, মানুষকে হত্যা ক’রে ধনরত্ন ও মেয়েদের চুরি করে আবার মরুপ্রান্তরে ফিরে যাওয়া —এই ছিল এদের কাজ। তাহলে এদের প্রাচীন কোন সংস্কৃতি কোথায় ? অনেকে শাহজাহানকে শিল্পী, সংস্কৃতমান, রুচিশীল ইত্যাদি বলে। কিন্তু heritage যেটা সেটাতে তো এসব কিছু নেই, ফলে ওদের মধ্যে যার যেটাতে রুচি সেটা ভারতে এসে শিক্ষা করেছিল বা অনেক সময় বাধ্য হয়ে এখানকার রীতিনীতি মেনে নিয়েছিল। প্রাচীন সংস্কৃতি বলতে ছিল ইরান এবং ইরাক (পারস্য ও মেসোপটেমিয়া) এই দুটো দেশে। সেখান থেকে কিছু শিল্পী বা রুচিবান মানুষ মুঘল আমলে রাজদরবারে ঠাঁই পেয়েছিল আর বাকী যারা, তারা কিন্তু ভারতীয়। তৎকালীন শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য সবকিছুই তাদের প্রভাবেই গড়ে উঠেছিল।
আকবরের কথা বলছ তো—আকবরের শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার নেপথ্যে ছিল টোডরমল—একজন হিন্দু অমাত্য। অসাধারণ বুদ্ধি ছিল লোকটির। সেই সম্রাটের মাথায় আর্যচিন্তা ঢুকিয়েছিল, অন্যথায় আকবর কখনই এত বিশাল রাজ্যবিস্তার করতে পারতনা। বাবর যখন দিল্লীর মসনদ দখল করে তখন তো দিল্লী আজকের মতো ভারতের রাজধানী ছিল না। তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শতখণ্ডে বিভক্ত ভারত। শত শত রাজ্য আর শত শত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নরপতি। বাবরের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল ইব্রাহিম লোদীর এবং পরে শেরশাহের। মহম্মদ ঘোরীর হাতে পৃথ্বীরাজ চৌহানের অপ্রত্যাশিত পরাজয় ও তাঁর মৃত্যুর পর ভারতের উত্তর-পশ্চিমে সীমান্ত দুর্বল হয়ে যায়। ফলে ঐ অঞ্চল দিয়ে তুর্কী, পারসিক, মোগল এরা বার বার ভারতে ঢুকে পড়ে এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করার চেষ্টা করে। সেইসময় ওদের নিজেদের মধ্যেই লড়াই চলছিল। রাজপুত, মারাঠা ও শিখরা প্রথমটায় মাথা ঘামায়নি। দ্যাখোনা বাবর ক্ষমতায় এল কিন্তু হুমায়ুন রাজ্যচ্যুত হল, শেরশাহ ক্ষমতায় এল আবার সে মারা যাবার পর তার উত্তরাধিকারী তেমন কেউ থাকল না, ফলে মুঘলরা আবার ক্ষমতায় এল এইরকম চলছিল।
কিন্তু আকবরের রাজ্যাভিষেক হবার পর টোডরমলের সঙ্গে আকবরের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বুদ্ধিমান টোডরমল আকবরকে বোঝাল বিশাল দেশ এই ভারতবর্ষ, এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য রাজ্য, অসংখ্য রাজা, কারোর সাথে কারো ভাব নেই। কিন্তু একটা ব্যাপারে তারা সবাই এক যে, তুমি বিদেশী এবং বিধর্মী। ভারতবর্ষের প্রাণ হচ্ছে ধর্ম। যদি তুমি কখনও সেখানে আঘাত দাও তাহলে তোমার পূর্বসূরিদের মতো তোমাকেও মসনদ থেকে বিদায় নিতে হবে। রাজ্যবিস্তার করতে বা গোটা ভারতবর্ষের একছত্র সম্রাট হতে কখনই পারবে না। তখন আকবর জিজ্ঞাসা করল, ‘তাহলে আমাকে কি করতে হবে ?’ ও বলল, ‘হিন্দুদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন কর । রাজপুতদের মর্যাদা দাও, কারণ ওরা বীর সৈনিক এবং বিশ্বাসী।’ আকবর তাই করেছিল, যোধাবাঈ-এর জন্য রাজপ্রাসাদের মধ্যে শিবমন্দির করে দিয়েছিল। আকবর প্রত্যহ খালি পায়ে পূজার পর সেখানে যেত এবং অমাত্যবর্গ অর্থাৎ জয়সিংহ, যশোবন্ত সিং ইত্যাদির সঙ্গে ভক্তিভরে পূজার প্রসাদ মাথায় ঠেকিয়ে খেত। সবাই ভাবল আকবর আর যাইহোক অন্যদের মতো নয়। কারও ধর্মবিশ্বাসে তো আঘাত হানে না অতএব একে মেনে নেওয়া যায়। এটাই হয়েছিল। হিন্দু মানসিকতাই এটা—যে তাদের কৃষ্টিকে মানে, তারা আর তার বিরোধ করে না। তৎকালে আকবরের সভাসদদের মধ্যে ৭০% রাজা ছিল হিন্দু, তারা বিরোধ করলে আকবরের সাম্রাজ্য খান খান হয়ে যেত, কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক আর ধর্মের প্রতি সহানুভূতির জন্যই কেউ বিরোধ করেনি। এই পুরো paln-টা ছিল টোডরমলের। প্রথমটায় হিন্দু রাজাদের আকবরের প্রতি ঘৃণা ছিল কিন্তু শিবমন্দিরে ভক্তিভরে প্রসাদ খেতে দেখে তা ধীরে ধীরে দূর হয়ে যায়। তবে রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও অন্যান্য জাতির কিন্তু ক্ষোভ ছিল। আকবর দীন-ই-ইলাহি নামে একটা নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করে। মুসলমান ধর্মের গোঁড়ামি থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছিল, ফলে ভেবেছিল অন্য জাতিও তা ধীরে ধীরে মেনে নেবে। কিন্তু শিখ বা মারাঠারা তা মেনে নেয়নি—বরাবর বিরোধ করেছে। ঔরঙ্গজেবের সময় যখন পুনরায় মুসলমান ধর্মের গোঁড়ামি প্রবলভাবে হিন্দুসমাজের উপরে আছড়ে পড়ল —সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেল। মারাঠা জাতির গৌরব শিবাজী। ওর প্রতি দৈব অনুগ্রহ ছিল। সদ্গুরু রামদাস সমর্থের শিষ্য শিবাজী আধ্যাত্মিক লোক ছিল। রামদাস সমস্ত রকম শিক্ষা ওকে দিয়েছিলেন। শিবাজী ৩০-৩৫ ফুট লাফাতে পারত, ওর তলোয়ার ছিল ৭ ফুট লম্বা। মহাভারতের সময় ভীম যেমন একাই একটা সৈন্যদলকে শেষ করতে পারত, শিবাজীও যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর রকমের ক্ষিপ্র ছিল। শিবাজীর উপর গুরুর নির্দেশ ছিল–যে কোন উপায়ে ঔরঙ্গজেবকে মারো। ফলে শিবাজী ধরা দিল, কারণ খালি হাত ছাড়া ঔরঙ্গজেবের কাছে যাওয়া যাবে না, ওর এমনিই security system ছিল। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের কাছে এই খবর যেভাবেই হোক পৌঁছে গিয়েছিল তাই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ওকে নিয়ে আসা হয়েছিল সম্রাটের সামনে। ঐ অবস্থাতেও শিবাজী ছেলেকে নিয়ে জেলখানা থেকে পালিয়ে এল, এটা অসম্ভবকে সম্ভব করার মতোই ব্যাপার ! শায়েস্তা খাঁর সঙ্গে লড়াই এর আগে শিবাজীর দর্শন হয়েছিল যে, শায়েস্তা খাঁকে আগে না মারলে সেই শিবাজীকে মেরে ফেলবে ফলে শিবাজীই আগে attack করেছিল। যাইহোক great বা মহান যদি বলতে হয় তৎকালের রাজাদের মধ্যে তবে শিবাজীকেই বল ।