জিজ্ঞাসু—ভারতবর্ষে তাহলে লুটপাট, শোষণ ইসলাম- ধর্মাবলম্বীরাই করেছে ?

গুরুমহারাজ—এটা আবার কি বলছ ? শোষণ সবাই করেছে তবে হয়তো একই রকম নয়। খ্রীষ্টানরা করেনি—ব্যবসার নামে অর্থনৈতিক শোষণ ? সমস্ত দেশীয় ব্যবসাদারদের সমস্ত ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং দেশীয় শিল্পসমূহের সর্বনাশ করে দিয়েছিল । সমস্ত কিছুই ওদের সামগ্রী কিনতে হতো—এই তো ইতিহাস । চরকা বিপ্লব হয়ে গেল সারা দেশে-গান্ধীজীর জনপ্রিয়তার এটাই কারণ জানবে । ইসলাম করেছে শোষণ ধর্মের নামে, কিন্তু হিন্দুরা তার স্বজাতির প্রতি কম শোষণ করেছে সামাজিকভাবে ? হিন্দুদের সংকীর্ণতা, জাতপাত আর অস্পৃশ্যতা দেশের বেশীর ভাগ জনগণকে দীর্ঘদিন ধরে উঠতে সুযোগ দেয়নি—এটা নিদারুণ শোষণ ! ঈশ্বরের রাজত্বে এ শোষণ অবাঞ্ছনীয়, তাইতো ভারতবর্ষের উপর নেমে এসেছে বারবার বিদেশীদের আঘাত ।


জিজ্ঞাসু—বলা হয় সবই ব্রহ্মের প্রকাশ । তাহলে জীবের প্রাণ আছে, চেতনা আছে, জড়ের নেই কেন ?

গুরুমহারাজ — জড়েরও প্রাণ আছে, চেতনা আছে। প্রাণ বলতে তোমার ধারণা কি ? প্রাণবায়ু ? না এটা ভুল। পঞ্চপ্রাণ বা পঞ্চবায়ুকে বলা হয়—প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান। কিন্তু উপনিষদের যে প্রাণবিদ্যা সেখানে বলা হয়েছে প্রাণই ঈশ্বর। সেই প্রাণের concept কিন্তু ভিন্ন । সেখানে প্রাণ সর্বান্তর্যামী, সবকিছুর মূলে হচ্ছে প্রাণ। জড় এবং জীবে প্রাণ পূর্ব থেকেই বিদ্যমান। আর চেতনার কথা বলছ ? চেতনার out ward manifestation হ’ল জড় এবং চেতনার inward manifes- tation হচ্ছে জীব। চেতনার inward ক্রিয়া থেকেই evolution শুরু হয়। যার চূড়ান্ত পর্যায় হ’ল মানুষ। মানুষের পর আর evolution নয় —envolution অর্থাৎ আত্মিক উত্তরণ বা চেতনার upward mani- festation. জড় আর জীবের মধ্যবর্তী virus, যাদের মধ্যে চেতনার inward এবং outward দুটো ক্রিয়াই বিদ্যমান। এরপরই উদ্ভিজ্জ এর highest manifestation অশ্বত্থাদি বৃক্ষ। গীতায় বিভূতি-যোগে পাবে, ভগবান বলছেন বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বত্থ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জীবের সংস্কার বোঝাতে উদাহরণ দিতেন, অশ্বত্থের গোড়া যতই কাটো আবার ফেকড়ি বেরোবে।” অর্থাৎ প্রচও জীবনীশক্তি । এখনও অশ্বত্থ বৃক্ষ নিয়ে ঠিকমতো research হয়নি, হলে দেখবে পরবর্তীতে এখান থেকে প্রচুর জীবনদায়ী ঔষধ আবিষ্কার হবে।

প্রাণীর দেহে প্রাণ কিভাবে এসেছে – এ সম্বন্ধে এখনও বিজ্ঞানীদের ধারণা অস্পষ্ট। কেউ কেউ বলছে D.N.A বা R.N.A এর জন্য দায়ী। কিন্তু এটা ঠিক নয়—ভুল। কারণ D. N. A বা R.N.A-র যে compo- sition নিউক্লিও অ্যাসিড বা প্রোটিন ইত্যাদি – এগুলি তো রসায়নাগারে তৈরী করা যায়, তাহলে তার মধ্যে প্রাণের ক্রিয়া শুরু হচ্ছে না কেন ? প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছিল প্রাণীর। লক্ষ লক্ষ বছর আগে তখনকার বিশেষ তাপমাত্রা, চাপ এবং vibration-এ বিশেষ পরিস্থিতিতে চেতনার অন্তর্মুখীনতা আসে এবং সৃষ্টি হয় প্রাণী। তারপর থেকেই অভিবিকাশ বা evolution হয়ে চলেছে। এই চেতনার inward ক্রিয়া এবং upward ক্রিয়া এখন হয়ে চলেছে—এটা চলবেও অনেক কাল। এখন মহাবিশ্বের expansion period চলছে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন যে, প্রতিটি মহাজাগতিক বস্তুর মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে, আবার একদিন শুরু হবে contraction, এটাও চলতে থাকবে অনেকদিন। অবশেষে যখন gravitation খুব বেড়ে যাবে তখন একে অপরের সঙ্গে collide করবে। এটাই লয় বা প্রলয় । এইভাবেই সৃষ্টি এবং লয় হয়ে চলেছে অনন্তকাল ধরে। আবার শুরু হবে নতুন সৃষ্টি। ফলে এই মহাবিশ্বের যে মহাজাগতিক নিয়ম—এখানে মানুষের চিন্তা-ভাবনা বা ক্রিয়াশীলতার ভূমিকা এতই নগণ্য যে, তা উপেক্ষা করা যেতে পারে। এইজন্যই জ্ঞানিগণ মানুষকে বাজিকরের পুতুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

এই যে লয়, এর পিছনেও অজস্র কারণ রয়েছে। যেমন প্রচণ্ড গুমট আবহাওয়ার পর এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস মানুষকে স্বস্তি দেয়, গুমট কাটায়, fresh-ness এনে দেয়, তেমনি মহাবিশ্বে নানারকম ঝঞ্ঝাট, বিশৃঙ্খলা, বেনিয়ম ধীরে ধীরে প্রকট হতে থাকে। শুধু যদি পৃথিবীগ্রহের বিচার করো তাহলেই দেখতে পাবে এখানে যেমন অসহজতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, বেনিয়ম বাড়ছে ঠিক তেমনি মহাবিশ্বেরও একই নিয়ম। যাইহোক মাঝে মাঝে সৌরঝড় পৃথিবীর অবাঞ্ছিত বর্জিত পদার্থকণাদের ঝেঁটিয়ে নিয়ে যায় তারপর আবার কিছু নতুন particle দিয়ে যায়—এভাবে কিছুটা শৃঙ্খলা বজায় থাকে। অনেকে ধূমকেতুকে অমঙ্গলের চিহ্ন হিসাবে চিহ্নিত করে, কিন্তু ধূমকেতু পৃথিবীর সামগ্রিক কি ক্ষতি করবে ? ধূমকেতু তো সৌর পরিবারেরই একজন, ওরও নির্দিষ্ট কক্ষপথ রয়েছে, না হলে বিজ্ঞানীরা কি করে বলছে যে, ওটা আবার এত বছর পর ফিরে আসবে ? ফলে ধূমকেতুও নির্দিষ্ট নিয়মেই আছে। কিন্তু ধূমকেতুর লেজের area-টা বড়, তাই ওটা একটা বিরাট field নিয়ে বেড়ায়। এর ফলে ও যখন পৃথিবীর কাছাকাছি হয় তখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কমবেশী হতে পারে। ফলে প্লাবন, ভূমিকম্প হয়ে যেতে পারে—উভয়ের মাধ্যাকর্ষণের হঠাৎ তারতম্যের ফলে একটা ঝাঁকুনি হতেই পারে। এইজন্য আবহাওয়া মণ্ডলের কোন পরিবর্তন হতে পারে, কোন নতুন virus জন্ম নিতে পারে বা কোন সুপ্ত virus ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে। এসবের জন্যই মানুষ ধূমকেতু এলে আশঙ্কা করে। হয়তো বহু পূর্বে কোন ধূমকেতু পৃথিবীর কাছাকাছি হওয়ার ফলে কোন ভয়ঙ্কর প্রলয়কাও ঘটে গিয়েছিল। মানুষের মনে পুরুষানুক্রমে সেই ভয়টা সঞ্চারিত হয়েছে। তবে মহাপ্রলয় —যেটা বললাম সেটা শুধু পৃথিবীর বা সৌরজগতের ক্ষেত্রে নয়, ওটা সমগ্র মহাবিশ্বে একইসাথে একইভাবে হয়। এই মহাজাগতিক নিয়মকেই ঈশ্বরের ইচ্ছা বলা হয় ।