জিজ্ঞাসু—ঈশ্বর এবং ব্রহ্ম কি এক ?

গুরুমহারাজ— অ — উ — ম্ — তৎ — সৎ,

                   বিরাট—হিরণ্যগর্ভ—ঈশ্বর— তুরীয়—ব্ৰহ্ম,

                    বিশ্ব — তৈজস— প্রাজ্ঞ—তৎপুরুষ—আত্মা।

ব্রহ্ম কি তো মুখে বলা যায় না, অবাঙ্মনসগোচর। শুধু মাঝে মাঝে সেই অনন্ত,. অসীম, অব্যক্ত ভাব থেকে কোন রূপ বা বিগ্রহ-রূপে সীমায় ধরা দেন, তখনই সেই রস-স্বরূপের একটু-আধটু বোধ হয়, আভাস পাওয়া যায় তাঁকে ঘিরে। সেই নরতনুকে বলা হয় অবতার, যুগাবতার ইত্যাদি। যেমন যাদুকরের স্বচ্ছ কাঁচ – তাতে যে যেভাব আরোপ করে, তাই দেখতে পায়—কেউ বাঘ, কেউ হাতি। কিন্তু জেনে রাখবে এরূপ অনন্ত ভাব আছে, অনন্ত ভাবময় তিনি। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ।’ ব্যাপারটা এইবার ঠিক ঠিক বুঝতে পারবে। অরণ্য আর বনের মধ্যে তফাৎ জান ? অরণ্য natural, বহু গাছ-পালা, লতা-গুল্ম, ঔষধি-বনস্পতির সমাহার—দিগন্ত বিস্তৃত দুর্ভেদ্য। তার মধ্যে কত জীবজন্তু, কত গাছপালাকে তার হিসাব রাখে ! আর বন মানুষের সৃষ্টি, যেমন বাঁশবন, তালবন, তপোবন। এগুলি বিশেষ purpose-এ সৃষ্টি করা হয়েছে। ঈশ্বর যেন অরণ্য আর অবতারাদি বন, যাঁরা বিশেষ purpose serve করার জন্য অবতীর্ণ হন। তাই সর্বব্যাপী, সর্বান্তর্যামী, পরম সত্যস্বরূপ, পরম চৈতন্যস্বরূপ এবং পরম আনন্দস্বরূপ সেই সর্বব্যাপী সর্বশক্তিমান ঈশ্বরই যখন ভোগায়তন শরীর নিয়ে যুগোপযোগী ভাব ধারণ করে জীব-জগতের কল্যাণার্থে আবির্ভূত হন—তিনিই অবতার।

জিজ্ঞাসু—বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ নিয়ে এত অস্থিরতা কেন ?

গুরুমহারাজ—এসব সম্প্রদায়গুলির ভিত নড়ে যাবার লক্ষণ। কিছু একটা হলেই ‘গেল গেল’ রব উঠছে। তাই ধর্মীয় মৌলবাদ দিয়ে জোর করে এটাকে ধরে রাখার চেষ্টা চলছে—কিন্তু এইভাবে বেশীদিন কোন জিনিসকে ধরে রাখা যায় না। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ষোড়শ শতকে নবজাগরণের ঠিক আগে খ্রীষ্টধর্মে ঠিক এরূপ ব্যাপারই ঘটেছিল। আজকের মত সেদিনও মৌলবাদ দিয়ে জোর করে চারদিকের বিশৃঙ্খলাকে চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল খ্রীষ্টান সমাজ অর্থাৎ চার্চের বিশপ ও পাদ্রীর দল। কিন্তু পারেনি—রেনেসাঁস হয়ে গেল। প্রথম বিশ্বের জনগণ মৌলবাদকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে এসেছিল। বর্তমানে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা চার্চ এবং পোপকে মাথা থেকে নীচে ফেলেছে। নাহলে ভাবতে পারো –নেদারল্যাণ্ডে প্রকাশ্য জনসভায় পোপ (দ্বিতীয় জন পল ) কে ডিম ছুঁড়ে মারল। ১০০ বছর আগে হলে এটা ভাবা যেত ?

সুতরাং প্রথম বিশ্বে মৌলবাদের আর জায়গা নেই—এটা তৃতীয় বিশ্বে এখন শিকড় গেড়ে বসেছে। আর শুধু গেড়ে বসা নয়, প্রথম বিশ্ব ও দ্বিতীয় বিশ্ব যত মৌলবাদের বাঁধন মুক্ত হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্ব তত বেশী করে বাঁধন গলায় পরছে। এইজন্যই দেখবে এই তৃতীয় বিশ্ব এখন বিভিন্ন বিপন্ন ধর্মীয় নেতাদের আশ্রয়স্থল। যখনই কোন ধর্মীয় নেতা বিপন্ন হবে—তারাই এসব দেশে পালিয়ে আসবে। এইভাবে ঐ ধর্মীয় নেতাদের আশ্রয়স্থল এখন তৃতীয় বিশ্ব আর এদেরও এমনই মানসিকতা যে, ওদেরকে গ্রহণও করবে।

যাইহোক কথা হচ্ছিল সাম্প্রদায়িকতা সম্বন্ধে। দেখ বিভিন্ন সাম্প্রদায় থাকা স্বাভাবিক কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ভালো নয়। তাই যে সম্প্রদায়েই মানবতাকে উপেক্ষা করে ধর্মীয় মৌলবাদকে জোর করে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে, সেখানেই যত হানাহানি ও রক্তপাত। এখন ঐ সম্প্রদায়গুলিতে যদি যুগোপযোগী বলিষ্ঠ নেতা না জন্মায় – তাহলে ধীরে ধীরে ওরা অন্য আদর্শকে গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। প্রাকৃতিক কারণেই তা হবে, কারণ প্রকৃতি কখনও অসাম্য বা অস্থিরতা চলতে দেয় না, সাম্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। মহাবিশ্ব প্রকৃতির নিয়ম আমি মিলিয়ে দেখি তো, এইজন্যই বলছিলাম কোন সমাজের অস্থিরতা ভাল নয়। কিছুদিন আগে একটা লেখকের বইকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গেল। এগুলো ভাল লক্ষণ নয়—চরম অস্থিরতা বা অসাম্যেরই লক্ষণ। বর্তমানে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিন্ন করে, কিছু দেশ কমিউনিষ্ট হবার পর ধর্মীয় কুসংস্কারগুলি পরিত্যাগ করছে। ঐ সমাজ- তান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি এখন ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসছে। প্রথম বিশ্বের তো বটেই, তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষিত সমাজ আজ আর ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আবদ্ধ নেই। তাই বলছি এখনও যদি কোন বলিষ্ঠ ধর্মীয় নেতা বা মহাপুরুষ ঐ সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন
সমাজে জন্মগ্রহণ না করেন তাহলে শুধুমাত্র মৌলবাদ দিয়ে ঐ সমস্ত সমাজকে টিকিয়ে রাখা যাবে না।

জিজ্ঞাসু—মক্কার কাবাশরীফ কি শিবমন্দির ?

গুরুমহারাজ—ইতিহাস তো তাই বলে। তাছাড়া ইতিহাস আরও বলছে যে, হজরত মহম্মদের বাবা, কাকারা বা পূর্বপুরুষেরা তো এখানকার পুরোহিত ছিলেন এবং ওরা মূর্তিপূজা করতেন। মহাকাল থেকেই মক্কা, তা থেকে মক্কা কথাটি এসেছে। মক্কেশ্বর শিবের মন্দির বা মহাকাল মন্দির। ওখানে মূল শিবলিঙ্গ ছাড়া আরও ৪৮০ টি বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি ছিল। হজরতের ছোটবেলা খুবই সাধন-ভজনে কেটেছে। উনি ভেড়া চরাতে চরাতে মেষপালকদের সঙ্গে চলে আসতেন হিমালয়ের প্রান্ত পর্যন্ত এবং ওখানেই বিভিন্ন যোগী সম্প্রদায়ের সঙ্গে ওনার যোগাযোগ ঘটে। তারপর যুবক বয়সে তিনি মক্কায় ফিরে যান এবং নতুন ধর্মমত প্রচার করতে থাকেন যা ওখানকার প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের বিরোধী। ফলে প্রথমে ওনাকে মক্কা ছেড়ে মদিনায় পালিয়ে যেতে হয়, পরে আলি এবং ওসমান নামে দুজন যোগ্য সহকারী পাওয়ায় উনি প্রথমে মদিনায় তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন এবং ওখানকার মানুষকে প্রভাবিত করেন। এরপর উনি পুনরায় মক্কায় ফিরে আসেন। এখানে ছোটখাট সংঘর্ষ হয়। ঐ সময় মহাকাল মন্দিরের সমস্ত মূর্তি আলি ও ওসমান ভেঙে ফেলেন। কিন্তু এমন কথিত আছে যে, ওদের একজন যখন পবিত্র শিবলিঙ্গ ভাঙতে যাবে এমন সময় ওখানে উপস্থিত হজরতের ভাবসমাধি হয়ে যায় এবং ভাবস্থ অবস্থায় তাঁর মুখ থেকে ‘আয়াৎ’ (ঈশ্বরের বাণী ও উপদেশ) বেরোতে থাকে, “দাঁড়াও, মূর্তিতে আঘাত কোরো না – এটি প্রাচীন পবিত্র পাথর। এতে মাথা দিয়ে শুয়ে নবীদের জ্ঞান হয়েছে, ওকে পবিত্রজ্ঞানে চুম্বন কর।”

হজরতের এই বিখ্যাত ‘আয়াৎ’ থেকেই আজও পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ‘হজ’ উপলক্ষ্যে মক্কায় যায়। দক্ষিণভারতের শিবমন্দিরগুলিতে শৈবরা যে আচার-উপবাস পালন করে, হজ করতে গেলেও প্রায় সেইরকমই অর্থাৎ মস্তকমুণ্ডন, কাছাবিহীন কাপড় পরা এবং উত্তরীয় নেওয়া, প্রদক্ষিণ ইত্যাদি অনেক কিছু আচারের similarity পাবে।