জিজ্ঞাসু—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমুখী প্রতিভা সত্যই বিস্ময়কর নয় কি ?

গুরুমহারাজ— তুমি রবীন্দ্রনাথকে খুবই ভালোবাস তাই না, বেশীর ভাগ শিক্ষিত বাঙালীই রবীন্দ্রনাথের ভক্ত হয়। তবে তুমি যে বলছিলে রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার কথা—হ্যাঁ অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভাকে নানান দিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন – কাব্যে, উপন্যাসে, ছোটগল্পে, প্রবন্ধে, চিত্রাঙ্কনে, নৃত্যে,
সুরসৃষ্টিতে, সংগীতে ইত্যাদি হয়তো আরও অনেক বলা যায়। কিন্তু আমার মতে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তাকে ‘বিশ্বকবি’ হিসাবে দেখাটাই সঠিক এবং যথার্থ। কাব্য প্রতিভায় প্রকৃতপক্ষেই তিনি বিশ্বের যে কোন প্রান্তের কবিদের কাছে আদরণীয় এবং ঈর্ষার পাত্র। যে কোন বিষয়ে কি অবাধ যাতায়াত এবং ছন্দ, অলঙ্কার, শব্দবিন্যাস যেন স্বতঃপ্রসারিত !

কিন্তু তাঁর প্রতিভার অন্যান্য দিকগুলির কোনটাই কিন্তু ততটা বিশ্বমানের নয়, যা সেই field-এর বিশ্বমানের শিল্পীদের কাছে ঈর্ষার বিষয় হতে পারে। সেটা উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক চিত্রাঙ্কণ ইত্যাদি। সকল ক্ষেত্রেই বলা যায় । হয়তো তোমরা যারা শিক্ষিত মানুষ, কলকাতার মানুষ এখানে বসে আছো, তারা দুঃখ পাবে কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমি নিরুপায় যে, সংগীতেও তিনি বিশ্বমানের হয়ে উঠতে পারেন নি। রবীন্দ্রসংগীতের main অসুবিধা হ’ল এখানে শিল্পীর নিজস্ব কোন স্বাধীনতা নেই—রবীন্দ্রনাথের বেঁধে দেওয়া সুরেই তাকে গাইতে হয়। তবু তোমাদের অনেকের হয়তো রবীন্দ্রসংগীত ভালো লাগে—সেটা কেন বলোতো— কথার জন্য। গানের কথাগুলি এত চমৎকার যে, শিক্ষিত মানুষের মনকে স্পর্শ করে। অর্থাৎ কবিতা হিসাবে সেটি চমৎকার। ঐ জন্যই বললাম ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’ – “বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ”, এটাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠ বিশেষণ। দ্যাখো, সংগীত সুরপ্রধান—কথাপ্রধান নয়। নাহলে বিভিন্ন রাগ-রাগিণী, বাদ্যযন্ত্র, মেঠো সংগীত বা লোকসংগীত মানুষের ভাল লাগে কেন—ওখানে তো তেমন কোন ভাল কথা নেই। তবু সুরগুলি মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করে— দেখবে সবাই গুন গুন করে গায়। রবীন্দ্রসংগীতের কথাগুলি সুন্দর বলেই শিক্ষিতরা এটাকে ভালোবাসে। চিন্তা করে দেখো, আমি যা বলছি তা সত্য কারণ আমি বিশ্বমনের reflection থেকে বলছি। আরও দেখবে অশিক্ষিত মানুষ রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত হলে রেডিও বন্ধ করে দেয় বা অন্য সেন্টারে দিয়ে দেয়। আমি অনেককে বলতে শুনেছি, রবীন্দ্রসংগীত ঘুমপাড়ানি গান। তাহলেই বুঝতে পারছ এটা সবার জন্য নয়, তাহলে স্বদেশেই এই অবস্থা হলে রবীন্দ্রসংগীত বিশ্বমানের কি করে হবে ! অপরপক্ষে নজরুলসংগীত কিন্তু বাঙালী জনগণ পছন্দ করে। এর কারণ সুরের বৈচিত্র্য। নজরুল শিল্পীদের দিয়ে সুর করিয়েছেন, তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাই নজরুলগীতির এত কদর! পরবর্তীকালে দেখবে যখন বিশ্বভারতীর নিয়মের ফাঁস আলগা হবে (তখন শিল্পীদের রবীন্দ্রসংগীতের উপরে স্বাধীনতা আসবে এবং তখনই নতুন নতুন সুরে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হবে) আর তা জনপ্রিয়ও হবে। এখনও দেখবে দেবব্রত বিশ্বাস বা পঙ্কজ মল্লিক রবীন্দ্রনাথের যে গানগুলিতে সুর দিয়েছিলেন সেগুলি শুনতে ভালো লাগে।

জিজ্ঞাসু—বাঙ্গালরা রান্নায় কি খুব পটু ? কারণ ওদের রান্না খুব rich, খেতেও ভালো লাগে ?

গুরুমহারাজ – না না, তেমন তো নয়। বর্তমান বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভাল খাবারের স্বপ্ন দেখে। কারণ দেশটি তো বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে নীচের সারিতে। ভারত বিভাগের আগের কথা ধরলে কিছুটা উন্নত ছিল বলতে পারো। কারণ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় শস্য এবং মাছের প্রাচুর্য ছিল— আর ব্যবসা-বাণিজ্যও চলত বিভিন্ন বন্দর থেকে। লোকসংখ্যা তুলনামুলক কম ছিল, ফলে ভালো খেতো বলা যায়। ওদের মধ্যে যারা এদেশে আগে এসেছে তারা ওখানকার এবং এখানকার দুটোর সংমিশ্রণে এরকম রান্না শিখে নিয়েছে। কেন আমাদের মা-ঠাকুমারা কি খারাপ রান্না করতো নাকি ? বাংলাদেশীরা ঝোল খায় বেশী, বলে ‘জুল’।

তবে rich রান্না যেটা বলছিলে – ওটা পশ্চিমভারতে। পাঞ্জাবিরা চারটে পরোটা তৈরী করতে ২৫০ গ্রাম ঘি খরচ করে। বাংলাদেশে ফলটা বেশী—আম, জাম, লিচু—কারণ প্রচুর নদী আর ঠাণ্ডা মাটি। এইজন্য ফল বেশী হয়। কাশী থেকে কম্বোজ এই স্থানের মধ্যে যে কোন জায়গায় এই জাতীয় ফল বেশী হয়।