জিজ্ঞাসু—আচ্ছা গুরুমহারাজ ! এত মানুষ আপনার কাছে আসে কেন ?

গুরুমহারাজ—আমি সবাইকে ভালোবাসি বলেই মানুষ আমার কাছে আসে। দ্যাখো, আমার আর কি আছে যে মানুষকে দেবো — অন্য যা কিছু পাবার জন্য মানুষকে অন্য জায়গায় যেতে হবে কিন্তু আমার একটাই দেবার—ভালোবাসা–আমি সেটাই দিই। সদা-সর্বদা আমি সকলকে এটাই দিয়ে চলেছি। মানুষও আমাকে ভালোবাসে তাই আসে। ভালোবাসার প্রতিদান ভালোবাসা—এটাই সূত্র। আমি এটা জানি বলেই এই সূত্র মেনে চলি।

একসময় আমি প্রচণ্ড বিচার-বিশ্লেষণ করেছি যে, মানুষকে কি দিয়ে বাঁধা যায় ? “শাসন” বা “অনুশাসন” দিয়ে ? উত্তর পেয়েছি—না। কারণ প্রতিটি মানুষের নিজস্ব মনোজগৎ আছে সেটাকে তুমি কি করে শাসনে রাখবে ? তোমার শাসন হয়তো মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হ’ল —কিন্তু মনে তৈরী হ’ল বিক্ষোভ। সুযোগ পেলেই তা একদিন বিদ্রোহের রূপ নেবে । রাজতন্ত্র-সামন্ততন্ত্রের যুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করো —দেখবে এই ঘটনা বারবার ঘটেছে। দ্বিতীয়ত মানুষকে ‘নিয়ম’ দিয়ে কি বাঁধা যায় ? এই সময় উঠবে, এই সময় খাবে, এই সময় জপ করবে, এই সময় কাজ করবে ইত্যাদি একটা তালিকা প্রস্তুত করে দেওয়া হ’ল কিন্তু মানুষ কি কখনও পারবে ঠিক ঠিক সেই তালিকামতো নিয়ম পালন করতে ! নানান বাধা এবং দৈহিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি শত-সহস্র কারণ ঐ ‘নিয়ম’-কে ‘বেনিয়ম করতে বাধ্য করবে। এবার যেটা দিয়ে অনেকটা বাঁধা যায় সেটা হ’ল আদর্শ। কোন আদর্শকে সামনে রেখে অনেক মানুষ অনেক সময় এক platfrom-এ আসে—সংঘবদ্ধ হয়। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি কারণ সেই আদর্শ যদি মানবকল্যাণমুখী না হয় – তাহলে সমাজে নেমে আসে হাহাকার, মৃত্যু, অবক্ষয়। হিরণ্যকশিপু বা রাবণকে আদর্শ করে অথবা শুক্রাচার্য্যের নীতিকে follow করতে গিয়ে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত এ ঘটনা বারবার ঘটেছে। আবার এই ‘আদর্শ” যদি কোন মহাপুরুষ হন যিনি ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’ নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন —তাহলেও দেখা যায় সেই মহাপুরুষের পরবর্তী generation-গুলিতে পূর্বতন আদর্শ বিকৃত হতে হতে তখনকার মানুষের মনগড়া কিছু নিয়মে পর্যবসিত হয়, ফলে মানুষ দুধ খেতে গিয়ে কাচ কামড়ে মরে।

এইভাবে বিচার করে দেখলাম—তাহলে আমি মানুষকে কি দেবো ?—উত্তর পেলাম—ভালোবাসা। তাই আমি মানুষকে শুধু নয় সকলকেই ভালোবাসি, ভালোবাসা দিই। এইজন্যই আমার দ্বারা কারও কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। দ্যাখো মানুষকে এমনিতে কঠোর, বিচারশীল, যুক্তিবাদী ইত্যাদি নানারকম মনে হলেও একদম core of the heart যে জায়গাটা—সেটা সকলেরই খুবই কোমল। সেখানে তোমার ঐ সকল শাসন, নিয়ম, লেক্‌চার, জ্ঞান, উপদেশ স্পর্শ করতে পারে না। একমাত্র প্রেমই সেই স্থানকে স্পর্শ করতে পারে বা বলা যায় জায়গাটাকে অধিকার করতে পারে। মহাপুরুষেরা প্রেমের দ্বারাই মানুষের হৃদয় জয় করেন। যীশু এটাই বলেছিলেন, রাজা ভয় পেয়েছিল। মহাপ্রভু এটাই করে দেখিয়েছিলেন। যাঁকে স্পর্শ করছেন—সেই তাঁর হয়ে যাচ্ছে— এটা এক সাংঘাতিক অবস্থা !


১লা বৈশাখ – ১৩৯৭ সাল, আশ্রমে অনেকে এসেছেন শুভদিন বলে—আসছেনও অনেকে, ভক্তদের কেউ
কেউ গুরুজীকে ফুল-বেলপাতা দিয়ে প্রণাম করছেন, কেউ মালা পরিয়ে দিচ্ছেন। গুরুমহারাজ সেগুলি তাড়াতাড়ি খুলে পাশে সরিয়ে রাখছেন। ভক্তদের মধ্যে থেকে কেউ একজন জিজ্ঞাসা করলেন – বাবা, আপনি কি মালা-পরা খুব একটা পছন্দ করেন না ?

গুরুমহারাজ—কি বলব বল। অনেকে দূরদূরান্ত থেকে আসে, তাদের ইচ্ছায় বাধা দেওয়া আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তবে সেটা অনেক সময় অত্যাচারে পরিণত হয়—এটা কষ্টের। গুরুজী প্রসন্ন হবেন কিনা, এভাব তো সবার থাকে না, তার নিজের বাসনা চরিতার্থ করার জন্যই এসব করে থাকে। আজকালকার দোকানে কেনা ফুল সাধারণত বাসী হয়, রঙ করে রেখে দেয়, বিভিন্ন রকমের পোকামাকড়ও থাকে তাতে। একবার ঐ রকম রঙ করা রজনীগন্ধার মালা কে একজন আমাকে পরিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরেই দেখি গলার কাছটা জ্বালা করছে, বেশ ফুলেও উঠেছিল, কোন বিষাক্ত পোকা ছিল বোধহয়, তাই ঐরকম হয়েছিল। আবার অনেকে এতক্ষণ ধরে প্রণাম করে যে, অন্য লোকে বিরক্ত হয়। অনেক মেয়েরা হয়তো ইচ্ছা করেই আমার পায়ে মাথা ঘষে ঘষে সিঁথির সিঁদুর লাগায়—এগুলো কি বলতো ? তারপর আরও মুশকিলে পড়ি–হয়তো সিটিং-এ কোন উচ্চস্তরের আলোচনা চলছে, সেই সময় কেউ এসে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করল বা মালা পরাল অথবা জিজ্ঞাসাই করে বসল, ‘গুরুজী কেমন আছেন ?’ তাকে উত্তর দিতে গিয়ে বা ঐ দিকে মনোনিবেশ করতে গিয়ে আগের আলোচনা দারুণভাবে ব্যাহত হয়। কারণ আমিতো মুখস্থ কোন কথা বলি না— একটা নির্দিষ্ট vibration থেকে ধরে নিয়ে কথা বলি। দুম্ করে সেখান থেকে অনেক নীচের level-এ নেমে আসতে হয়—এতে খুবই কষ্ট হয়। সর্বোপরি অনেকে আশ্রম থেকেই ফুল-বেলপাতা ছিঁড়ে আমাকে দেয়। এটা আমার ভালো লাগে না। কত কষ্ট করে আশ্রমিকরা ফুল গাছ তৈরী করে—সে সব কথা না ভেবে ফুলগুলো ছেঁড়া কি মানুষের উচিত ? বাড়ীতে ফুল চাষ করে সেখান থেকে ফুল নিয়ে এলে সেটাকে আমি প্রসন্নভাবে গ্রহণ করি কারণ এর পিছনে ভক্তের শ্রম ও ভক্তি বা নিষ্ঠা মিশ্রিত রয়েছে। কিন্তু সাধারণের এসব জ্ঞান নেই, জানতো কথায় আছে —মানুষ ব্ৰহ্মজ্ঞান চাইছে অথচ কাণ্ডজ্ঞানের অভাব।

তবে, আমার প্রকৃতি অনুযায়ী আমি সব ফুল পছন্দও করি না। সাদা রঙের ফুল এবং গেরুয়া বা হলুদ ফুল ভাল লাগে। গেরুয়া ফুল —যেমন চাঁপা, হিমালয়ান ধুতুরা। সাদা ফুলের মধ্যে পদ্ম আমি খুব ভালোবাসি। এছাড়া জুঁই, বেলফুল, বকুল, শিউলি এগুলি ভালোলাগে। কিন্তু রজনীগন্ধা ভালোলাগে না, ওটা যেন বিয়ে-বাড়ী আর মৃতদেহ সাজানোর ফুল বলে মনে হয়। কেন এমন হয় কি জানি–হয়তো বিদেশী ফুল বলে আমার সংস্কারে নেই। লাল ফুল আমার একদম ভাল লাগে না। কোন কবি জবাকে তামসিক বলে উল্লেখ করেছেন। লাল রঙ উগ্রতার প্রতীক। ঐ জন্য যেখানে কালীর উগ্ররূপ সেখানে জবার যেমন সমারোহ তেমনি রক্তের প্লাবনও বেশী—দুটোই লাল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একবার কোন এক জায়গায় উগ্র কালীমূর্তির ছবি দেখে গৃহস্বামীকে বলেছিলেন—ছবিতে প্রতিদিন লাল জবা ফুল দিতে না পারলে সংসারের অনিষ্ট হবে। বিহারের রাজারাম্পায় ছিন্নমস্তার মন্দিরে কত পাঁঠা আর মোষ যে বলি হয় তার ইয়ত্তা নেই—রক্তের ধারা বয়ে গিয়ে নীচে নদীতে মেশে। নেপালের দক্ষিণাকালিকার মন্দিরেও বিশেষ পূজার দিন প্রচুর বলি হয়—প্রায় ৭০-৭৫টা মোষ বলি হয় আর প্রত্যেক শনি- মঙ্গলবার প্রায় প্রতি মিনিটে একটা করে বলি হয়। এই সব বীভৎসতা আমি নিজের চোখে দেখেছি, তাই লাল রঙটাই আমার ভাল লাগে না।