জিজ্ঞাসু—তাহলে কি ঐ ঘটনার পর থেকে আপনাকে আর কখনই খাওয়া-দাওয়া বা থাকার ব্যাপারে কোন অসুবিধায় পড়তে হয় নি ?
গুরুমহারাজ- দ্যাখ, সুবিধা বা অসুবিধা এগুলি মনের ব্যাপার। এক অর্থে পৃথিবী গ্রহটাই তো অসুবিধার জায়গা। এখানে শীতকালে শীত, গ্রীষ্মকালে দুঃসহ গরম, বর্ষাকালে প্যাচপেচে কাদা, বৃষ্টি ইত্যাদি নানারকম অসুবিধা দেখা যায়। তবু তো মানুষ সহ সমস্ত জীব এই পৃথিবীতে বাঁচতে চায়, আনন্দ করতে চায় বা বলা যায় আনন্দের সঙ্গে বাঁচতে চায়। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল ! এখানে অসুবিধাটাকে সুবিধা করে নিতে হয়, যে এ কাজটা যত বেশী ভাল করে করতে পারে তার adoptibility তত বেশী, অর্থাৎ survival of the fittest নিয়মে সে যোগ্যতম।
যে সময়ের কথা আমি তোমাদের বলছি—ঐ সময় অন্যান্য বিষয়ে বেশী মনোনিবেশ করার অভ্যাস আমার ছিল না। আমার ভিতরে তখন এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা—সত্য কি তা জানার, ঈশ্বর কি তা খোঁজার। এসব করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সময় কেটেছে। এখন সেগুলো বলার সময় তোমাদের গুছিয়ে বলতে পারছি যেহেতু আমার জীবনে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনাই বিস্মৃতি হয়নি। তবে সেই মুহূর্তে এসব ঘটনাগুলির কোনটাই আমাকে বিচলিত করতে পারেনি বা আমার সংকল্পকে টলাতে পারেনি।
আহার, নিদ্রা, মৈথুন ও ভয় এই চারটি বৃত্তিকে আশ্রয় করে সাধারণত জীবন কাটায় মানুষসহ সমস্ত জীব। এবার এর মধ্যে থেকে একটা মানুষ অনাহারে বা অনিদ্রায়ও যে থাকা যায়—সেটা কি করে ভাববে বল ? তাই নির্ভয় কেন, অভয়ও যে হওয়া যায় বা জৈবিক বৃত্তিগুলিকে যে জয় করা যায়—সেটা সে কি করে চিন্তা করবে ? এই জন্যই সাধারণ মানুষ প্রথমেই কোন সাধু ব্যক্তিকে দেখলে তাকে তাচ্ছিল্য করতে চায়, অবজ্ঞা করতে চায়। কারণ সে ভাবে—সাধুটি ভণ্ড-মিথ্যাবাদী। যেহেতু সে নিজে ওগুলিকে অতিক্রম করতে পারেনি বা পারে না তাই ভাবে বোধহয় জগতে কেউই পারে না। এই ভাবেই নিজের দৃষ্টিতে জগৎ দেখে মানুষ। তার উপর সত্যিই যদি কোন অসাধু সাধু সেজে ভণ্ডামি করে থাকে, ব্যস হয়ে গেল—চাই কি–প্রমাণ হাতেনাতে। অতএব সিদ্ধান্ত সাধু মানেই ভণ্ড ।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়, সাধু মানেই সৎ, যে ভণ্ড সে সাধু নয়, সে অসৎ। ‘ভণ্ড সাধু’ বলে একটা কথা আছে এটা ব্যাকরণগতভাবে ভুল শব্দ । Self contradictory শব্দ। ‘সাধু’ আবার ‘ভণ্ড’ হয় নাকি ? হয় ভণ্ড নয় সাধু, ভণ্ড-সাধু হতে পারে না। আর যদি সাদা পোশাক, হলুদ পোশাক, গেরুয়া পোশাক পরলেই সাধু ভাবো, সেটা তো ভাবনার ভুল। সাধু মানে যিনি সত্যে প্রতিষ্ঠিত। তবে কেউ গেরুয়া পোশাক পরছেন এবং ‘সাধু’ হতে চেষ্টা করছেন সেটা ঠিক আছে আর যিনি পোশাক পরেও অসৎ আচরণ করছেন, তিনি ভণ্ড, তিনি প্রতারক
—এই তো সিদ্ধান্ত।
এবার আমার জীবনের কথায় আসছি। যদি অনাহারে থাকার কথা বল, তাহলে বহুদিন একটানা আমাকে অনাহারে থাকতে হয়েছে । কোন সময় ক্ষুধার অনুভূতিহীন অবস্থায় সময় কেটে গেছে, কোন সময় আবার তীব্র ক্ষুধার তাড়না অনুভব করেছি, ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে গাছের পাতা, আমের কুসি, শাক, ফুল-ফল – এমনকি শ্যাওলাও খেয়েছি। আঃ ! কি সুন্দর তাদের স্বাদ ! আর কি তাদের পুষ্টিগুণ, আনন্দে নৃত্য করেছি আমি সেগুলি গ্রহণ করে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অনাহারে থাকার জন্য মায়ের সঙ্গে আমার একটু-আধটু মান-অভিমানের পালাও হয়েছে। কাশীতেই হয়েছিল এমন ঘটনা। তিনদিন হয়ে গেল কাশীতে ঘুরছি কোথাও খাইনি, ভাবলাম মায়ের প্রসাদ খাবো কিন্তু যতবার যাই ঠিক তখনই প্রসাদ দেওয়া বন্ধ। এইভাবে বার বার ফিরে আসার পর ভাবলাম আর যাব না। মন্দির থেকে বহুদূরে গঙ্গার ধারে ধারে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম অনেকটা। এক জায়গায় একটা গাছের ছায়া দেখে গিয়ে বসলাম, তার আগে অঞ্জলিভরে খানিকটা জল খেয়েছিলাম। এটা খুব করতাম, যখনই ক্ষিদে পেতো যতটা পারতাম জল খেয়ে নিতাম। জলেতেও কিছু দ্রবীভূত লবণ বা ভিটামিন রয়েছে এর খানিকটা তো শরীরে পুষ্টিগুণ জোগাতো। আর আমার শরীরের এমন system যে, কোন জিনিসের সামান্যতম গুণাবলীরও পুরোটা নিয়ে নিতে পারে। তাছাড়া কথায় আছে না ‘খালি পেটে জল ভরা পেটে ফল’। তাই ভাল পরিষ্কার জল পেলে খালি পেটে খেয়ে নেওয়া যায়। যাইহোক সেই গাছতলায় বসে বিশ্রাম করছি, এমন সময় এক পাগলী বৃদ্ধা নোংরা কাপড়-চোপড় পরে একগাদা ছেঁড়া ন্যাকড়া-বাঁধা শতছিন্ন পুঁটলি নিয়ে আমার কাছে এসে হাজির। একটু আগেই তাকে আমি দেখেছি জঞ্জাল ফেলার জায়গায়। পরিত্যক্ত কিছু খাবার পড়েছিল আর সে একপাল কুকুরের সঙ্গে তাই ভাগাভাগি করে নিচ্ছিল। হঠাৎ সেই বৃদ্ধা আমার পাশেই বসে পড়ল। তারপর আমাকে বলল, “কিরে বাছা! কিছু খাওয়া হয়নি মনে হচ্ছে- দাঁড়া আমার কাছে কি আছে দেখি।’ এই বলে ঝোলার ভেতর হাতড়াতে লাগল, ওকে দেখেই আর ওর খাবারের কথা মনে পড়তেই তো আমার ক্ষিদে উধাও হয়ে গেল ! মনে মনে ভাবলাম যতই খালি পেট হোক তোমার দেওয়া খাবার খাব না। ও যেন আমার মনের কথা শুনতে পেল, ভুক্তাবশিষ্ট কুড়ানো খাবার বের করতে করতে বলল, ‘আমার দেওয়া খাবার খাবি না, খা বলছি!’ এই বলে সেই অশীতিপর বৃদ্ধা অবলীলাক্রমে আমার মাথার পিছন দিয়ে বাঁ হাতটা ঢুকিয়ে যেমন করে শিশুকে জননী কোলে নেয়, তেমনি করে আমাকে কোলে বসিয়ে নিয়ে সেই খাবার জোর করে আমার মুখে ঢুকিয়ে দিল, ‘আঃ কি আস্বাদ সেই খাবারের ! আমি বিভোর হয়ে খেতে লাগলাম আর সে পরম স্নেহে আমাকে খাওয়াতে লাগল।
এইভাবেই কাশীতে মা অন্নপূর্ণার সঙ্গে আমার মন্দিরে সাক্ষাৎ হল না, কিন্তু গাছতলায় হল। তারপর অনেক কথা, অনেক গল্প হল। ওখানে চিরকাল ধরে বাবা বিশ্বনাথ এবং মা অন্নপূর্ণা স্থূল শরীরে কোন না কোন রূপে বিরাজ করেন, ‘কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।’ আমি যখন ওখানে ছিলাম মা বৃদ্ধা পাগলীর বেশে সারা কাশী ঘুরে বেড়াত, আমিও ঘুরতাম, ফলে মাঝে-মাঝেই দেখা হোত। একবার গঙ্গার ঘাটে দেখা, মা আমাকে বলল, “ঘাটের পাশে যে মুচিটা একমনে নাম জপ করছে আর জুতো সেলাই করছে, সে একজন মহাত্মা। ঘাটের পিছনেই যে আশ্রমটা রয়েছে, পূর্ব জন্মে ও ঐ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ও গুরু ছিল। কর্মবিপাকে এই জন্মে ওর মুচির ঘরে জন্ম হয়েছে। তাই মাঝে মাঝেই ওর কাছে যাই আর ওকে ওর পূর্ব জন্মের স্মৃতি ফিরিয়ে দেবার জন্য বলি, ‘সাধু মরণ সে হুঁশিয়ার’। ও রেগে যায়—বুঝতে পারে না, আমাকে তাড়া করে আর আমি হাসতে হাসতে পালিয়ে যাই।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওর দুর্বিপাকের কারণ কি ? পূর্বজন্মের সাধু এবং অতবড় একটি আশ্রমের আচার্য হয়েও এমন কি অন্যায় করল যে, ওর এই দুর্গতি ?’ তখন মা সাধুর পূর্বজন্মের ঘটনা বলতে লাগল : “ঐ সাধুর পূর্বজন্মে অনেক গৃহী ও সন্ন্যাসী শিষ্য ছিল। গৃহী ভক্তদের মধ্যে একজন ধনী ব্যক্তি তার গুরুদেবকে একটা দামী শৌখিন জুতো দিয়েছিল। জুতোজোড়া দেখে গুরুদেব খুব সন্তুষ্ট হল এবং মনে মনে ভাবল, বিশেষ বিশেষ উৎসব-অনুষ্ঠানে ঐ জুতো ব্যবহার করবে—এতে তার সম্মান বৃদ্ধি পাবে। এই বলে জুতোজোড়া ভাল করে কাগজে প্যাকিং করে ঘরের উঁচু তাকে রেখে দিল। এরপর নিত্য ব্যবহার্য জুতো পরেই তার চলে যেতে লাগল আর নানা কার্যোপলক্ষ্যে ঐ দামী জুতোর কথা সে ভুলেই গেল। যাইহোক দিন কেটে যেতে থাকে, গুরুদেব বৃদ্ধ থেকে অতিবৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুশয্যায় পড়ে গেল, সেই অবস্থায় উপর দিকে চেয়ে তার চোখে পড়ে গেল কাগজে মোড়া প্যাকেটটি — তৎক্ষণাৎ স্মৃতিতে ভেসে উঠল জুতোজোড়ার কথা। আর প্রাণটা অস্থির হয়ে উঠল এই ভেবে যে, আহা ! অমন সুন্দর জুতো—একবারও পরতে পারলাম না !” এইভাবে নিদারুণ দুঃখ হতে লাগল তার মনে। আর ঐ কথা ভাবতে ভাবতেই তার প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে গেল।
এইভাবে যে সাধু সারাজীবন ধ্যান-জপ,সাধন-ভজন ও সৎসঙ্গের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করল, মৃত্যুকালীন জুতো-চিন্তা করার জন্য পরবর্তী জন্মে তার মুচির ঘরে জন্ম হল। আর ছোটবেলা থেকেই তার কাজ হল নানান জুতা তৈরী করা ও জুতা মেরামত করা। তবে পূর্বজন্মের শুভ সংস্কার থাকার জন্য কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটেই সে বসে ঐ কর্ম করত যেখান দিয়ে বহু সাধু-মহাত্মার যাতায়াত ছিল এবং তাঁদের সংস্পর্শ- সান্নিধ্য ঘটত। আর আমিই পাগলীরূপে তার পূর্ব জন্মের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য মাঝে মাঝে ওর কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলি, ‘সাধু ! মরণ সে হুঁশিয়ার!’ ঐ চিৎকারে যুবক মুচির অন্তরটা কেঁপে উঠতো কিন্তু কিছু বুঝতে পারত না।” –মায়ের মুখে ঐ ঘটনা শুনে যোগভ্রষ্ট মুচির প্রতি আমার কেমন একটা করুণা হল। মাকে বললাম, ‘মা, একটু দোষের জন্য ওর এতটা দুর্ভোগ ! আর কেন, এবার তুমি কৃপা কর।’ মা শুনে বলল, ‘তুই বলছিস, আচ্ছা ঠিক আছে।’ এই বলে মা তার কাছে গিয়ে ওর থুতনিটা ধরে আদর করে বলল, ‘হ্যাঁরে জুতো পরবার তো খুব সাধ হয়েছিল, তা এবার কত জুতো—নাড়াচাড়া কর —কত জুতো পরবি পর ! মুচিটি ঐ স্পর্শে বিহ্বল হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকাল কিন্তু পরিষ্কার কিছু বুঝে উঠতে পারল না, তখন মা ওর মাথায় হাত দিতেই পূর্বজন্মের সমস্ত স্মৃতি তার মনে পড়ে গেল এবং তৎক্ষণাৎ গভীর আত্মচৈতন্যে নিমগ্ন হয়ে পড়ল – হাত থেকে খসে পড়ল চামড়া ও যন্ত্রপাতি।