জিজ্ঞাসু—আমার মামা একজন ধনী কিন্তু সুদখোর। উনি আবার খুব ধর্ম-কর্ম এবং পুজো-আচ্ছাও করেন। আমি ওনাকে সুদ নেওয়াটা যে খারাপ, তা বলার চেষ্টা করছিলাম তা উনি বললেন, ‘বাবা, আমি তোর থেকে শাস্ত্র বেশী পড়েছি, তাতে লেখা আছে, আগে ঐশ্বর্য পরে মাধুর্য’। তাই উনি ঐশ্বর্য বাড়িয়ে চলেছেন। উনি কি এটা ঠিক করছেন ?
গুরুমহারাজ—বাবা! তোর মামা তো কংসমামা শকুনিমামার থেকেও সাংঘাতিক রে ! জানিস তো, একবার কুসীদজীবির অন্নগ্রহণ করলে দশ হাজার বার ইষ্টমন্ত্র জপ করলে তবে অন্নদোষ নষ্ট হয়— এটাও শাস্ত্রে আছে। তাহলে কথা হচ্ছে, যার অন্নে এত দোষ – সেই ব্যক্তিটি কেমন দুষ্ট হবে সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। তোর মামা কি বলছে—আগে ঐশ্বর্য পরে মাধুর্য ? এটা ঠিকই বলেছে, শাস্ত্রবাক্য মিথ্যা হয় না। তবে যেমনটি আর পাঁচজন করে থাকে এখানেও তাই হয়েছে —অর্থাৎ ব্যাখ্যার ভুল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন—মানুষের শক্তি কাম-কাঞ্চনেই নিবন্ধ, ফলে ধারণাশক্তির একান্ত অভাব। কোন ব্যাপারেই মানুষের ঠিক ঠিক ধারণা জন্মায় না। একমাত্র সদগুরুর কৃপাতেই মানুষের ধারণা বা conception জন্মায়। আর নিয়মিত অভ্যাসের দ্বারা এই conception থেকে আসে perception। বাবা, এখানে ঐশ্বর্য মানে টাকা-কড়ি বা ধন-দৌলত নয়, এখানে ঐশ্বর্য হচ্ছে ‘ভালোবাসা’। এটি বৈষ্ণবশাস্ত্রের কথা। ব্যাখ্যাকাররা এই শব্দের ঠিকমতো ব্যাখ্যা করেন নি তাই তোর মামার বুঝতে গোলমাল হয়েছে। আমার এক-একসময় মনে হয় বৈষ্ণবরা নিজেদেরকে বড় বেশী ‘দীন’ ভাবতে গিয়ে ‘হীন’ হয়ে গেছে। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকেও শ্মশ্রুহীন মাকুন্দ বানিয়েছে আর নিজেরাও মাকুন্দ হয়েছে। রাম বা কৃষ্ণকেও দাড়ি-গোঁফহীন ভাবে চিত্রায়িত করেছে। দেখো ‘সুন্দর’ বোঝাতে কিশোর বয়সকেই বেছে নেওয়া হয়, ফলে কিশোর অবস্থার ছবিতে দাড়ি-গোঁফহীন এটা মানা যায়, কিন্তু গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর বা শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত লীলাই কি দাড়ি-গোঁফহীন অবস্থায় হয়েছিল ? মহাপ্রভুর তো গায়েও লোম নেই ! তাহলে কি ধরে নিতে হবে প্রতিদিন ভোরে উঠে উনি save করতেন—এগুলো পাগলামি নয় কি ? মহাপ্রভু সিংহ রাশির জাতক, সুতরাং তাঁর শরীর অত্যন্ত রোমশ ছিল। কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদের ন্যায় তিনি বৃন্দাবনের দিকে অথবা নীলাচলের পথে ছুটে চলেছেন, ফলে সেই অবস্থায় তাঁর বড় বড় দাড়ি-গোঁফ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী একবার কোন স্থানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দাড়ি- গোঁফ-বিশিষ্ট একটি ছবি দেখে খুব আনন্দ করেছিলেন। যাক ওসব কথা, কারণ এতে হয়তো অনেকে ব্যথা পাবে।
যাইহোক কথা হচ্ছিল ঐশ্বর্য মানে ভালোবাসা বা প্রীতি। শাস্ত্রে তিন প্রকার প্রীতির কথা বলা হয়েছে – সঙ্গজ, গুণজ ও নৈসর্গিক। সঙ্গজ-প্রীতিতে ‘আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছা প্রবল। একে সাধারণী রতিও বলা হয়। বেশীর ভাগ মানুষের এই প্রীতি। সমঞ্জসা রতি বা গুণজ প্রীতিতে অধিক পরিমাণে ভগবৎ প্রীতি বিদ্যমান, কিন্তু স্বাভিমানযুক্ত পুরুষকার বিদ্যমান। তাই কিঞ্চিৎ সম্ভোগ ইচ্ছা বিদ্যমান। আর উত্তম প্রীতি হচ্ছে নৈসর্গিক প্রীতি। কোন আত্মসুখ-সম্ভোগ ইচ্ছা এখানে নেই। তাই এটা সমর্থা রতি।