জিজ্ঞাসু— মন কিসে বশে আসে ?
গুরুমহারাজ —‘অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহাতে’ —গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে একথা বললেন। অভ্যাসযোগেই মন বশীভূত হয়। অভ্যাসের দ্বারা কিনা হয় আর মন বশে আসবে না ? কুম্ভমেলায় একজন সাধু আসতো সে শরীরের যে কোন অঙ্গকে নাচাতে পারতো কিন্তু অন্য অঙ্গগুলি স্থির থাকতো। এইটা অভ্যাস করতে তার কত বছর লেগেছে বলতো ? এই যে বর্তমানের ভারতীয় ব্যায়ামবিদ মনোহর আইচ্ তার বাইসেপ্স পেশি দেখিয়ে গোটা পৃথিবীতে নাম করেছে কিন্তু এটা করতে তার কি কম সময় লেগেছে ? একজন তুর্কী মহিলাকে আমি দেখেছিলাম, তিনি তার নাভিতে পর পর আটটি মুদ্রা রেখে দিয়ে সেগুলিকে নাচাতে পারতেন। শেষে তাঁর এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে, ঐ মুদ্রাগুলির একটিকে স্থির রেখে বাকি সাতটিকে নাচাতে পারতেন অথবা ১/৩/৫/৭ সংখ্যক মুদ্রাগুলি স্থির রেখে ২/৪/৬/৮ সংখ্যক মুদ্রাগুলিকে নাচাতে পারতেন। বলতো এটা কি অসাধারণ অভ্যাসের ফলে সম্ভব হয়েছে ! একজন মহিলা যোগী ছিলেন গিরিবালা, উনি কোন স্থূল খাদ্য গ্রহণ করতেন না, সূর্য থেকে নিজের শরীরের পুষ্টির জন্য যাবতীয় রসদ সংগ্রহ করে নিতেন। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতীর হঠযোগ জানা ছিল। একবার তিনি খেতরীর মহারাজার অতিথি হয়েছিলেন। রাজার দুটো বিলেতি ‘জোকো’ গাড়ি ছিল। তৎকালীন গাড়ি মানে বুঝতেই পারছো কেমন heavy engine । দয়ানন্দ রাজার সঙ্গে challenge করেছিলেন যে, ঐ গাড়ি দুটির মাঝখানে তাঁকে রেখে যদি লম্বা দড়ার সঙ্গে তাঁকে ও গাড়ি দুটিকে পৃথকভাবে বেঁধে দেওয়া হয় তাহলে গাড়ি ২টি ১ ইঞ্চিও আগাতে পারবে না। মহারাজ একথা শুনে বিস্মিত হয়ে সমস্তরকম ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। গাড়ি দুটিকে বিপরীত দিকে রেখে দয়ানন্দকে লম্বা দুটি পৃথক দড়া দিয়ে গাড়ির সাথে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। গাড়ি দুটোকে চালু করার পর টপ গিয়ারে দিয়েও একটু আগানো যায় নি। এই ঘটনা নিজের চোখে দেখে খেতরীর মহারাজা দয়ানন্দকে খুব মানতো।
দয়ানন্দর মতো এমন শক্তিশালী লোক খুব কম দেখা যায়। একবার উনি লাহোরে জনসভায় বক্তৃতা করছেন, সভায় অনেক শিখ, পাঞ্জাবি শ্রোতাও রয়েছে, এমন সময় হঠাৎ উনি বলে বসলেন, ‘নানকের ব্যাকরণ জ্ঞান নেই তো ব্রহ্মজ্ঞান কি করে হবে ?” হয়তো নানকের কোন লেখায় ব্যাকরণগত কোন ভুল ছিল। যাইহোক, যেই একথা বলা—একজন সর্দার সঙ্গে সঙ্গে একলাফে কৃপাণ হাতে স্টেজে উঠে পড়েই ‘বাহে গুরুজী কা খালসা’ বলেই এক কোপ ! কিন্তু ওরা দয়ানন্দকে তো চেনে না, উনি কি নিজের সামর্থ্যের কথা না জেনে মৌচাকে ঢিল মেরেছেন ! ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কৃপাণ ধরে ফেলেই দয়ানন্দ সেটাকে দু’টুকরো করে ফেলে দিলেন। তারপর সর্দারজীকে এক হাতে ধরে দু’পাক ঘুরিয়ে উঁচু স্টেজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন অন্তত ৩০ ফুট দূরে। এই দেখে অন্যান্য সর্দারজী যারা সেখানে উপস্থিত ছিল তারা ‘যো বোলে সো নিহাল, সংশ্রী অকাল’ বলে মারল ছুট। তাহলেই ভাব, দীর্ঘ অভ্যাসের দ্বারা লব্ধ যোগশক্তির সাহায্যে কি অসাধারণ দৈহিক শক্তিই না লাভ করেছিলেন দয়ানন্দ !
আমার এই ধরণের বহু ঘটনাই মনে পড়ে যাচ্ছে। অনেকেই দেখেছে রায়নার কাছে জামালপুরের একজন এক হাতে চাগিয়ে একটা পূর্ণবয়স্ক মোষ তুলতে পারত। হয়েছে কি ঐ মোষটি যখন বাচ্ছা তখন থেকেই ও প্রতিদিন একহাতে করে তাকে তোলা অভ্যাস করে। ফলে মোষটা যখন পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেল তখন আর তাকে তুলতে ওর অসুবিধা হত না। হরিদ্বার থেকে কালের দিকে যাবার পথে একজন সাধু থাকতো সে দেড় কুইন্টাল মাল তুলতে পারতো। এইভাবে তুমি হাজার প্রমাণ পাবে যে, নিয়মিত ও নিষ্ঠার সঙ্গে অভ্যাস করলে সব কিছুই তোমার বশীভূত হতে পারে। মনকে বশ করা তো কঠিন কিছু নয়—কিছুদিন অভ্যাস কর, আমার কথার সত্যতা তুমি নিজেই টের পাবে।