জিজ্ঞাসু—পূর্বজন্মের পুণ্যকর্মের ফলে না প্রারব্ধবশত সদগুরু লাভ হয় ?

গুরুমহারাজ— প্রারব্ধবশত বংশ পরম্পরার গুরুলাভ বা অন্য কোনভাবে দীক্ষা হতে পারে কিন্তু সদগুরুলাভ হয় না। মুমুক্ষুত্বম্ অর্থাৎ ব্যাকুলতাই সদগুরুলাভের উপায়। প্রয়োজনের তাগিদ অনুভব হলেই মানুষ প্রাপ্য বস্তুর অন্বেষণে নামে। যেমন ক্ষুধার উদ্রেক হলে তোমার খাবারের কথা মনে আসে, তারপর তুমি খাবারের অন্বেষণে যাও, ঠিক তেমনি ঈশ্বরের প্রতি ব্যাকুলতা আসলে কার কথা তোমার মনে আসবে ? নিশ্চয়ই তাঁর কথা—যিনি তোমাকে শান্তির সন্ধান দিতে পারবেন বলে তোমার মনে হচ্ছে –তাই নয় কি ? এইভাবে বিভিন্ন উপগুরুর কাছে ঘুরতে থাকে মানুষ। ঠিক তখনই সদগুরু নিজেই তাকে খুঁজে নেন যখন তাঁর উপর সম্পূর্ণ ভার দিয়ে সে নিশ্চিন্ত হতে পারে। তাই বলা হয় ‘গুরু করবি শত শত মন্ত্র করি সার, মনের মতো মানুষ পেলে তাঁরে দিবি ভার। ‘

জিজ্ঞাসু—সদ্গুরু চিনতে পারলে তো আর অন্য গুরু খুঁজে বেড়ানোর দরকার নেই, তাহলে কি উপায়ে সদগুরু চেনা যায় ?

গুরুমহারাজ—সদগুরু চেনার প্রচলিত কোন উপায় নেই। ঈশ্বরের শক্তি গুরুর মধ্যে দিয়ে ক্রিয়াশীল হয়, অন্তিমে গুরু ইষ্টে লীন হন। সদগুরুকে কি চেনা যায় ? গুরুর কৃপা হলে তিনি নিজেই ধরা দেন, তাঁর স্বরূপ প্রকাশ করেন। তুমি কি করে চিনবে –গুরু কি কোন বস্তু বা জিনিস যে তাঁকে টিপেটুপে বোধ হলে তবেই গুরু কি তা জানা যায়। গুরুবাক্যে অসংশয়, গুরুতে ঐকান্তিক নিষ্ঠা অথবা গুরুর সেবা—এতেই গুরু তুষ্ট হন আর তাঁর কৃপাতেই সব হয়—এটাই রহস্য।

জিজ্ঞাসু—হঠযোগের কথা একটু আগে বলছিলেন, এতে শরীরের কি ধরণের শক্তি হতে পারে ?

গুরুমহারাজ—প্রাচীনযুগ থেকেই ভারতীয়রা হঠযোগ-বিদ্যা আয়ত্ত করে অসাধ্য সাধন করে এসেছেন। মহাভারতের যুগে কৃষ্ণ, ভীষ্ম, কর্ণ, অর্জুন, দ্রোণ ইত্যাদি সবার যে কবজের কথা বলা হয়েছে এগুলো কিছুটা বর্তমানের Remote Control-এর ন্যায়। যা Neuclear অস্ত্ৰ বা যে কোন রাসায়নিক অস্ত্রকেও প্রতিহত করতে পারতো। এছাড়া এই ধরণের বীররা শারীরিক শক্তিতে বা মানসিক দৃঢ়তায় অত্যন্ত উন্নত ছিলেন।
Steel nerve বলতে সাধারণত অন্য অর্থ বোঝায়, এদের কিন্তু প্রকৃতই স্নায়ুগুলি ইস্পাতের ন্যায় সুদৃঢ় ছিল। ফলে কোন ধারালো অস্ত্রই এসব শরীরকে চট করে বিদ্ধ করতে পারতো না। মাংসপেশীতে বিদ্ধ হলেও, স্নায়ু আহত না হওয়ায় অনায়াসে সেগুলি খুলে ফেলে পুনরায় এঁরা পূর্বের অবস্থা প্রাপ্ত হতে পারতেন। বর্তমানে জাপানের ‘নিন্জা’ সংঘতে এই ধরণের ক্রিয়া শেখানো হয়। একে বলে তাইচি। প্রচণ্ড যোগাভ্যাস, নিয়ম, সংযমপালন করতে হয় বলে সাধুরাই বেশী এই বিদ্যায় পারদর্শী হ’ন। ব্রুস-লি-ও এই বিদ্যা শিখেছিল। এখন চেষ্টা চলছে শরীরকে আরও দৃঢ় করে বুলেট আটকানো যায় কিনা। ব্রুস-লি সম্ভবত এটিই অভ্যাস করতে গিয়ে মারা যায়। তার মৃত্যুর আর একটা কারণ হ’ল যেহেতু সে এই বিদ্যাকে public show করছিল, তাই তার গুরু রুষ্ট হয়ে তার মৃত্যুকামনা করেছিলেন, তবু চূড়ান্ত ঘটনাটি ঐভাবেই ঘটেছিল। বৌদ্ধযুগে ভারত থেকে এই বিদ্যা চীন, জাপান, কোরিয়া ইত্যাদি দেশে যায়। পরবর্তীকালে ওরাই এটা গ্রহণ করল আর আমরা ভুলে বসলাম। তাই এখন এসব শিখতে হলে ঐদেশীয় শব্দ বা শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। তবে ভারতীয় যোগীদের মধ্যে এখনও গুরু পরম্পরায় সমস্ত বিদ্যাটিই সংরক্ষিত হয়ে আছে। এমন অনেক সন্ন্যাসী আছেন যাঁরা তথাকথিত black belt, blue belt-দের মুহূর্তে কাবু করে দেবেন। আমিও এমন একটি সংঘে (তিব্বতে) কয়েকমাস শিক্ষা করেছিলাম।

খণ্ডযোগ নামে হঠযোগের একটি বিভাগ আছে। এটি অভ্যাস করে শিখতে পারলে শরীরের যে কোন অঙ্গকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে আবার জুড়ে দেওয়া যায়। শিরডির সাইবাবা এই যোগ জানতেন। তাঁর স্নান করা কেউ কখনও দেখেনি, সম্ভবত তিনি ঐ সময় practice করতেন। একবার একজন দুর্বৃত্ত কয়েকজন গুণ্ডা পাঠান তাঁকে হত্যা করার জন্য। গুণ্ডাগুলি রাত্রে তাঁর কুটিরে গিয়ে হাজির হয়ে দেখে শিরডি সাইবাবার হাত দুটো দুদিকে পড়ে, পা-দুটোও এখানে ওখানে ছড়ানো, ধড় থেকে মুণ্ডুটাও আলাদা। ওরা ভাবল ওদের আগেই অন্য কেউ বোধহয় তাঁকে মেরে রেখে গেছে। তারা যেই ফিরে যাবার জন্য পিছু হটেছে অমনি পিছন থেকে আওয়াজ এল, ‘কি হল পালাচ্ছ কেন ? যে কাজ করতে এসেছ করে তবে যাও।’ ওরা তাকিয়ে দেখে যে, জ্যোতির্ময় পুরুষ শিরডি সাইবাবা প্রচণ্ড হাসি হাসি মুখে বসে আছেন। গুণ্ডারা ব্যাপারটায় অত্যন্ত ঘাবড়ে গিয়ে প্রণাম করে সরে পড়ল।

এই রকম আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল কুম্ভমেলায়। কুম্ভমেলা সাধুদের মেলা, পরবর্তীকালে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, কেউ পুণ্যের আশায়, কেউ মজা দেখার আশায় সেখানে ভিড় করে। সেবার রাজপুতানার কোন রাজার একটা বিরাট তাঁবু খাটানো হয়েছে এক জায়গায়, সেপাই-সান্ত্রী চারিদিকে প্রহরায়, কারণ রাণীরা আছে তাঁবুর ভিতর। এদিকে একজন মহাত্মা উলঙ্গ হয়ে কুম্ভমেলার চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাধুটি ঐ রাজার তাঁবুর barricade-এর মধ্যে দিয়েই ঢুকে পড়ছেন দেখে সেপাই ‘তফাৎ যাও—তফাৎ যাও’ বলে হাঁকতে শুরু করেছে কিন্তু কে শোনে কার কথা ! সাধুটি আরও ভিতরে যেই ঢুকে পড়েছেন—সেপাই তরোয়াল খুলেই এক কোপ। সাধুটির বাঁ হাত এক কোপেই বাহু থেকে কেটে মাটিতে পড়ে গেল। এটা না করলে সেপাইটার হয়তো গর্দান যাবে, কাজেই তাকে দোষ দেওয়া যায় না। এদিকে সাধুর অঙ্গে আঘাত ! কিন্তু ঘটনাটা ঘটল কি, সাধুটি একবার হেসে পড়ে যাওয়া কাটা হাতটি কুড়িয়ে নিয়ে ঠিক জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে আবার আগের মতোই হেঁটে চলে গেলেন। আর কেউ মহাত্মাটির সন্ধান পেল না। ঘটনাটি অনেকেই দেখেছে কারণ কুম্ভমেলায় লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়। আমার সাথেই একজন বৃদ্ধ সাধুর এ ব্যাপারে কথা হয়—তিনিও নিজের চোখে এই ঘটনাটি দেখেছিলেন। এইবার ভাবো, কি ধরণের উন্নত যোগবিজ্ঞান এই হঠযোগ, আজকের শারীরবিজ্ঞান যা ভাবতেও পারেনা, এগুলি কিন্তু সত্য ঘটনা। কৃষ্ণও হঠযোগ জানতেন, কারণ তাঁকেও কোন অস্ত্রে আহত করা যেত না। রাবণ, রক্তবীজ এসব মহাবীরেরাও এই ধরণের বা আরও উন্নত বিজ্ঞান জানতেন। এগুলি কল্পনা বলে উড়িয়ে না দিয়ে প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করাই ভালো। সত্য আজও সত্যই আছে, শুধু প্রচেষ্টার অভাবে তা কল্পনার আবরণে ঢাকা আছে। আবরণ উন্মোচিত হলেই সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়বে।