জিজ্ঞাসু—আদি শংকরাচার্য বলেছিলেন—’সবই মায়া-কল্পনামাত্রম্’ এটা কি রকম যদি একটু বলেন ?
গুরুমহারাজ—ঠিকই তো, সমস্তই কল্পনামাত্র কীটাণু থেকে সগুণ ব্রহ্ম পর্যন্ত সবই কল্পনা, ‘সমস্তম্ কল্পনামাত্রম্ আত্মামুক্ত সনাতনম্। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, কল্পনাকারী কল্পনা নয়। একটা গল্প আছে শোন—এক খ্যাপা জঙ্গলে ঘুরছিল, হঠাৎ একটা বাঘে তাকে তাড়া করে, সে তখন প্রাণপণে যীশু, বুদ্ধ, ভগবান—সবাইকে ডাকতে থাকে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনজন দেবদূত এসে হাজির, তার মধ্যে একজন চীনা, একজন ইউরোপীয় এবং একজন ভারতীয়। সে তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল— চীনা দেবদূত বলল, ‘দেখো ভাই – বাঘটি নিশ্চয় ক্ষুধার্ত তাই সে তোমাকে আক্রমণ করতে আসছে, তুমি হিংসা করো না—তার ধর্ম তাকে পালন করতে দাও।’ ইউরোপীয় দেবদূত বলল—’হিংসা দিয়ে হিংসার অবসান করা যায় না, ওকে ক্ষমা করো তারপর ওর বধ্য হও।’ ক্ষ্যাপা তখন ভারতীয় দেবদূতের দিকে তাকালো, সে বলল, ‘হে অমৃতের পুত্র ! কে বাঘ – কি হিংসা–কোথাও কিছু নেই, সমস্তম্ কল্পনামাত্রম্। একমাত্র তুমিই আছো—কারণ তত্ত্বমসি। ‘
তাই বলছিলাম কল্পনাকারী কল্পনা নয়, বাকী সমস্তই কল্পনা। কিন্তু সেই কল্পনাকে ‘কল্পনা’ বলে বোধ করাটাই উদ্দেশ্য। কিন্তু তার আগে কল্পনাকেই তো সত্য বলে বোধ হচ্ছে আর এখানেই যত গোলমাল। ‘গোলের’ মধ্যে ‘মাল’ আছে সেটা যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ শুধু আসা-যাওয়াই সার।
জিজ্ঞাসু—ঈশ্বরের ধ্যান বা চিন্তনে কি এইভাবেই কল্পনা সত্য হয়ে উঠে ?
গুরুমহারাজ—একটা কথা ভুল করো না—ঈশ্বরকে চিন্তা করা যায় কি ? তুমি ঈশ্বরের চিন্তা করতে পারো ? পারো না – হয়তো কোন মূর্তি বা কোন বিশেষ একটি রূপকে ভাবছ—এটাই কি ঈশ্বর ? তা নয়। ধর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তোমার ইষ্ট, তুমি সুখাসনে খালি গায়ে বসে থাকা ঠাকুরের মূর্তির চিন্তা করছ—অথবা ভাবস্থ অবস্থার মূর্তি—একটা হাত বুকে, একটা হাত ঊর্ধ্বে—এটাই চিন্তা করছ, এটাই কি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ? ঠাকুরকে ভাবতে গেলে সেই ঢেঁকিশালের নবজাতক গদাধর থেকে কাশীপুর উদ্যান বাড়ীতে রোগক্লিষ্ট জীর্ণ-শীর্ণ দেহ–অন্তিম শয্যায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের যে জীবন সেই মহাজীবনরূপী ঠাকুরকে ভাবতে হবে—পারবে তা ?
জিজ্ঞাসু—না হয়তো পারবো না, কারণ ঠাকুরের সবটাতো দেখা হয়নি।
গুরুমহারাজ—তাহলে যাঁকে দেখছো, তাঁকেই ভাবো, এটাই আরও ভাল ধ্যান হবে। কিন্তু আমার বক্তব্য ছিল এই যে, ঈশ্বরের ধ্যান করতে গিয়ে তুমি কি তাঁকে ছোট থেকে অতি ছোট করে ফেলছো না ! Ulti- mately ধর যে তুমি তাঁকে পেলেই কিন্তু সেইভাবে পাওয়াটা কি পূর্ণ পাওয়া হবে ? তাই বলছিলাম হয় পূর্ণটাকেই কল্পনায় এনে চিন্তা করতে হবে অথবা কিছুই কল্পনা করা চলবে না।
স্বামী বাউলানন্দ আমাকে ধ্যান কিভাবে করতে হবে তা বলেছিলেন —উনি বললেন, ‘ধ্যানের সময় ভাববে
অন্ধকার ঘর, সেই ঘরে কিছু একটা আছে—(সেটা কি তা জানা নেই) সেটাকে খুঁজে বের করো।’ এবার মজা দেখো জিনিসটা কি তা বলে না দেওয়ায় তার কোন কল্পনাও আসবে না—এলেও তৎক্ষণাৎ তা চলে যাবে। কারণ বস্তুটি ছুঁচও হতে পারে—হাতিও হতে পারে, যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ তো মালুম হচ্ছে না। এইবার জিনিসটা যদি বলে দেওয়া হয় তবে সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটার কল্পনা মনে ভেসে উঠবে। অন্ধকারে হাতড়াবার সময় যদি কোন জিনিস হাতে ঠেকেও তবে কল্পনার বস্তুটির সাথে যদি না মেলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। স্বামী বাউলানন্দ বললেন কোন অন্ধকার ঘরে বস্তুটির অন্বেষণই ধ্যান। বেদে বলা হয়েছে অস্তি, ভাতি, প্রিয়। বস্তুটি আছে—অস্তি, এবার খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল—ভাতি। তারপর আস্তে আস্তে তার স্বরূপ জানা গেল—প্রিয়।
আমার নির্বিকল্পের সময় এইভাবে ধ্যানে বসেছিলাম। গুরুদেব রামানন্দ অবধূত বলতেন, নিত্য নির্বিকল্প—ইচ্ছামাত্রই নির্বিকল্প হতে পারে-ওর জন্য আবার সংকল্প করে বসার কি দরকার ! কিন্তু তিনিও আমার নির্বিকল্পের আগে ধ্যানের এই পদ্ধতির কথা শুনে প্রায় আধঘণ্টা চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন, ‘অব্ যাও বিশ্রাম করো।’