জিজ্ঞাসু–কাশীতে মা অন্নপূর্ণা ও বাবা বিশ্বনাথ কি সর্বদা সশরীরে উপস্থিত থাকেন ?

গুরুমহারাজ—নিশ্চয়ই। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দেখেছিলেন কাশীর শ্মশানঘাটে যে সমস্ত মৃতদেহ সৎকার হচ্ছে—সাক্ষাৎ শিব তাদেরকে উঠিয়ে কানে মন্ত্র দিয়ে মুক্তি দিচ্ছেন। এবার এসব তিনি প্রত্যক্ষ করছিলেন বলে কি তা সবার প্রত্যক্ষ হবে ?

জিজ্ঞাসু—আপানার ‘খাবার চেয়ে’ নিগৃহীত হবার ঘটনাটা শুনেছিলাম, ওটা কখন ঘটেছিল ?

গুরুমহারাজ—এগুলো অনেক আগের ঘটনা, তখন আমার বয়স ১০/১১ বছর হবে। বিহারের জামালপুর রেলস্টেশনে এক বাবু বসেছিল। আমি তার কাছ থেকে পয়সা চেয়েছিলাম কিছু খাবার কেনার জন্য কিন্তু সে তা না দিয়ে পেটে লাথি মেরেছিল, ক্লান্ত শরীরে আমি সে আঘাত সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাই। তখন স্টেশনের কর্মরত কুলিরা আমাকে তাদের বস্তিতে নিয়ে গিয়ে সেবা-শুশ্রূষা করে। সব শুনে ওখানকার একজন ভাঙ্গীবাবা আমাকে বলেছিল, ‘যদি চাইতেই হয় তাহলে কারও কাছে না চেয়ে রামের কাছ থেকেই চেয়ো।’ একথাটি আমার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এরপর থেকে আমি কখনই কোন মানুষের কাছে খাবারের জন্য হাত পাতিনি। তবে অনেক সময় কোন সাধু বা সন্ন্যাসীকে পরীক্ষা করার জন্য সাহায্যের কথা বলেছি। দেখেছি যাঁরা উন্নত তাঁরা কত উদার। কিন্তু যারা আধ্যাত্মিকভাবে অনুন্নত, তারা কোন আশ্রমের মোহান্ত, মণ্ডলেশ্বর হলেও অন্তরে কি কঞ্জুস, কি অনুদার তারা। হৃদয়-বৃত্তিরই বিকাশ ঘটেনি তো মস্তিষ্ককোষের বিকাশ কি করে ঘটবে ! তবে ন’কাকা একদিন জামালপুরের ঐ লোকটির কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করায় আমি আশ্রমের ঘরে বসে অতীত স্মৃতির রোমন্থন করতে করতে লোকটির বর্তমান অবস্থা জানার চেষ্টা করছিলাম, দেখলাম লোকটি শূকরযোনি প্রাপ্ত হয়েছে। ঘটনাটা ঘটেছিল কি, আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঐ ঘটনাটির কিছুদিন পরই লোকটি heart stroke-এ মারা যায়। তারপরই ওর শূকরজন্ম হয়। আমি যখন দেখলাম, ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে—তখন ছিল ওর সপ্তম শূকরজন্ম। এর আগে ও ছ’বার শূকরযোনিতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং প্রতিবারই দেড় বছর/দুই বছরের মধ্যেই ওর পিছন দিক দিয়ে গরম লোহার শিক ঢুকিয়ে ওকে হত্যা করা হয়েছে। এসব দেখে আমি মা জগদম্বার কাছে ওর জন্য প্রার্থনা করলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি তো ওকে কোন অভিশাপ দিইনি, তাহলে ওর ঐ দশা হল কেন ?’ মা উত্তর দিয়েছিলেন যে, ‘তুই না চাইলে কি হবে মহাপ্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এটা হয়েছে।’ আমি মাকে অনুরোধ করলাম, ‘মা এবার ওকে ছেড়ে দাও – —মুক্তি দাও।’ মা বললেন, ‘কালের নিয়মে এটাই হবে। কারণ এটাই ছিল ওর সপ্তম শূকরজন্ম। কষ্টে মৃত্যু ও ইতরযোনিতে জন্মগ্রহণ করে এবারই ও মুক্তি পেয়ে আবার মনুষ্যশরীর পাবে।’ পরে ও মনুষ্যশরীর পেয়ে আমার সান্নিধ্যে এসেছে।

এইভাবে দেখা যায় মানুষের শরীর-মনে কষ্ট বা আঘাত দেওয়া খুব খারাপ। যে কোন জীবকেই আঘাত দেওয়া খারাপ তবে যদি এটা মানুষের ক্ষেত্রে হয় তাহলে সেটা আরও খারাপ। কেননা মানুষের মনোজগৎ
রয়েছে, অন্তঃকরণ রয়েছে, বিশ্বমনের সঙ্গে যা একীভূত। কোন কারণে ব্যক্তিমনের আঘাতজনিত বেদনা যদি একমুখী হয়ে বিশ্বমনকে স্পর্শ করে তাহলে মারাত্মক effect হয়। আর কে জানে কার বেশে কে আসে, তাই মহামানবেরা সুশিক্ষা দিয়ে গেছেন, ‘পরপীড়নম্ পাপম’– অপরকে পীড়ন করা অপরাধ। যীশু বলেছেন— ‘ক্ষমা করো।’ কতবার ক্ষমা করবে ? না seventy times seven. অর্থাৎ অসংখ্যবার, আমি বলি action এর reaction করো না, শুধু proper action কর, তাহলেই প্রারন্ধের ক্ষয় হবে। সঞ্চিতকর্ম নষ্ট হবে। অন্যথায় ভোগান্তি আরও বাড়বে বৈ কমবে না। রাবণ কত জনকেই তো হেনস্তা করেছিল, কত রমণীর চুল ধরে টেনেছিল – কিন্তু সর্বনাশ হয়ে গেল যেই সীতার চুলে হাত দিল। মহাজাগতিক মনোজগৎ কেঁপে উঠল, ব্যস রাবণের সবংশে নিধন অতি ত্বরান্বিত হয়ে গেল।