জিজ্ঞাসু—আপনার নির্বিকল্পের সময়কার ঘটনা বলেছিলেন ঠিক স্মৃতিতে নেই, যদি আর একবার বলেন !

গুরুমহারাজ—বীর্যহীনতাই স্মৃতিভ্রংশের কারণ। বেশীরভাগ মানুষই তার জীবনের অধিকাংশ কথা ভুলে যায়। একমাত্র যোগীরা ডুবুরীর মতো ডুব মেরে মেরে অতীতের সমস্ত স্মৃতি তুলে আনতে পারেন। যাইহোক জিজ্ঞাসা যখন করছো আবার বলতে হয়। স্বামী বাউলানন্দ যেভাবে ধ্যানের প্রক্রিয়া ( অস্তি, ভাতি, প্রিয় ) বলেছিলেন এইভাবে প্রথমেই বনগ্রাম আশ্রমের আগের ছোট কুঠিয়ায় বসি। তাতে কিছু অসুবিধা দেখা দেওয়ায় ২/৩ দিন পর রাতে রাতেই তৃষাণের সাথে মধ্যমগ্রামে চলে যাই, এখানে একথা একমাত্র ন’কাকারা জানতেন। ওখানে তৃষাণের বাড়ীতে ঠাকুরঘরে একটানা ২১ দিন দেহটা ছিল। ওরা প্রথমটায় দেহটা বালিশ দিয়ে খাড়া রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পরে পড়ে যায়। ওদিকে আমার চেতনায় দেহবোধ ছিল না, মন হুহু করে উপরে উঠে চলছে তারপর যেন হঠাৎ কোন জলে ঝপাং করে পড়ার মতো যেন কোথাও ডুবে যাচ্ছি—এমন বোধ হল, ওঠার চেষ্টা করছি দেখি ৪ জন অত্যন্ত সুন্দরী মহিলা আমাকে ধরে তুলে দিল। তারপর আবার ঊর্ধ্বগতি, প্রচণ্ড সেই গতিতে হঠাৎ দেখি সামনে ছোট ত্রিকোণাকার গর্তের মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হবে। খানিকটা যেন ভয়েই, ‘জয়মা’ বলে চোখ বুজেছি। আর ভোমরা যেমন প্রচণ্ড গতিতে এসে এইটুকু একটা শুকনো কাঠের গর্তে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ে, আমিও তেমনি সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লাম। আবার পরম আনন্দময় সাগরে এসে পড়লাম। এখানে ১৬ জন বিষ্ণুমূর্তি আমার চারিদিকে ঘিরে দাঁড়াল। এই সব অবস্থায় যেতে এখানে কদিন কেটে গেছে জানিনা, তারপর হঠাৎ একদিন দেখি গুরু বাউলানন্দের ডান হাত আমাকে চেপে ধরেছে। পাখীর বাসায় শাবককে কেউ যদি মুঠি দিয়ে চেপে ধরে বাইরে আনার চেষ্টা করে তখন ঐ পক্ষীশাবক যেমন প্রাণপণ চেষ্টায় বাসার খড়কুটো যা থাকে তাকেই ধরে আটকে থাকতে চায় আমারও তাই অবস্থা হল। প্রাণপণ শক্তিতে আমি সেই অবস্থাকে আঁকড়ে থাকতে চাইলাম। কিন্তু গুরু বাউলানন্দের প্রবল আকর্ষণে আমাকে সে অবস্থা থেকে উঠে আসতে হল। ওখান থেকে তুলে আনার পর আবার তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। অসহায়ভাবে আমি অনেক নীচে পড়তে যাচ্ছি, দেখি সন্তানহারা ব্যাকুলা জননী যেমন গভীর ব্যাকুলতায় তার সন্তানকে কোলে নিতে চেষ্টা করে তেমনি ব্যাকুলভাবে মা জগদম্বা আমাকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সদাসর্বদা ইষ্টদেবী মায়ের কোলেই আছি। এখানে মজার জিনিস দেখো—ইষ্টদেবী ব্যাকুলা হলেন কিন্তু গুরুদেব আমাকে টেনে আনলেন। ইষ্টের থেকেও গুরুশক্তি এক্ষেত্রে প্রবল। তাই প্রকৃত গুরু যে কি জিনিস, এ রহস্যের কিনারা পাওয়া খুবই দুরূহ। তাই বলা হয়, ‘গুরু ছেড়ে গোবিন্দ ভজে, সে পাপী নরকে মজে। ‘

যাইহোক এদিকে এখানে প্রায় ২১দিন কেটে গেছে। মুখ, নাক দিয়ে প্রচুর পিঁপড়ে ঢুকে ভিতরটায় বাসা করে ফেলেছিল। পিঁপড়েরা চোখেরও খানিকটা ক্ষতি করেছিল। মাটিতে গর্ত কেটে ইঁদুর আমার ‘থাই’-এর কাছে প্রায় ৪৫০ গ্রাম মত মাংস কেটে খেয়ে নিয়েছিল। পরবর্তীকালে আমার বোধ হয়েছিল যে, বিভিন্ন যোগীরা পিঁপড়ে বা ইঁদুরশরীর ধারণ করে এই শরীরটাকে ঠিক রাখার জন্য ঐসব করেছিল। যাইহোক, ধীরে ধীরে শরীরবোধ আসতে থাকল বটে কিন্তু সমস্ত অঙ্গগুলি প্রায় বিকল হয়ে যাবার মত অবস্থায় ছিল। চোখে ভাল
দেখতে পেতাম না, কানে ঠিক শুনতে পেতাম না, পৌষ্টিক নালির ক্রিয়াও প্রায় ছিল না। এইভাবে ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হতে প্রায় ৩/৪ মাস লেগে গিয়েছিল। তৃষাণ, পুতুলমা, ন’কাকা এরা সবাই এই শরীরটাকে খুব ভালোবাসে, ফলে ওরা বিভিন্নভাবে এটার সেবা করেছিল। বিভিন্ন কবিরাজ আনিয়ে অনেকরকম চেষ্টা করেছিল। আমার মুখ থেকে প্রথম স্পষ্ট শব্দ বেরোয়, ‘পেরেন্টাপল্লী’। ঘটনাটা ঘটেছিলো কি, তৃষাণ আমাদের অনাথ আশ্রমের একটি ছেলে ‘মনা’-কে নিয়ে এসেছিল আমার কাছে। মনা প্রণাম করে আমার সামনে দাঁড়াতেই আমার মনে পড়ে গেল পেরেন্টাপল্লীর আদিবাসী যুবক ‘হরি’-র কথা। সে খোঁড়া ছিল, আমি যখন ওখানে ছিলাম তখন সে সব সময় আমার কাছে কাছে থাকতো, আমার খাবার ভাগ করে খেত। একদিন একটা ফল নিজে আধখানা কামড়ে খেয়ে তারপর আমাকে খেতে দিয়েছিল। এর কিছুদিন পর হঠাৎ সে মারা যায়। সেই হরিই তো এই ছেলেটি—এটা ভেবেই আমার স্মৃতিতে এল পেরেন্টাপল্লীর কথা। তাই উচ্চারণ হল পেরেন্টাপল্লী। ফলে একটু সুস্থ হবার পর আমরা প্রথমেই পেরেন্টাপল্লী গিয়েছিলাম।

সে যাইহোক, ঐ অবস্থায় আমার সর্বদা বোধ হত যে, গোটা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডটাই যেন আমার হাতের তালুতে রয়েছে—হস্তমলকবৎ। তবে এসব কথা তোমাদের আর শুনে কাজ নেই।