জিজ্ঞাসু—আপনি বাইরে গেলে বেশী আহার্য গ্রহণ করেন না দেখেছি—এটা কেন ?

গুরুমহারাজ—বেশী খাবার আমার শরীরে প্রয়োজন হয় না, তাই বেশী খাই না ! আহার্য গ্রহণে আমার শরীরের বিশেষ অসুবিধা হয় না, তবে বিভিন্ন স্থানে অপরের বিছানায় শুলে একটু অসুবিধা হয়। Negative ভাবসমূহ হু হু করে ঢুকে শরীরটার ক্ষতি করে। কিন্তু এসব বললে পরে আবার এটাই untouchability ধরে নেবে উত্তরসূরিরা। জানোতো কথা আছে, “গুরু মোতে খাড়াইয়া, তো শিষ্য মোতে পাক দিয়া।”

অমুক বাবাজী যা ছিল ছিল, তার শিষ্যরা আবার এককাঠি সরেস। অব্রাহ্মণ হলেই আর ছোঁয় না, এক পঙতিতে বসতেও দেয় না। তাই আমি কি আমার সুবিধা-অসুবিধার কথা বলে এরকম আর একটা মত বানাবো ? তাই এসব কথা কাউকে বলি না। প্রকৃতপক্ষে এগুলো untouchability নয়। তবে নিজের practical বোধ না হলে স্পর্শদোষে বা অন্নদোষে কিসের হানি হয় তা বুঝতেও পারা যাবে না। কিছুদিন যদি কোন মানুষ স্বপাক রান্না খায়, তারপর অন্যের হাতে খায় তাহলে অন্নদোষের ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। আবার কিছুদিন সাধন-ভজন, ধ্যান অভ্যাস করলে স্পর্শদোষের কুফলও টের পাবে। সাদা কাপড় পরে কাজলের ঘরে ঢুকলে যে অসুবিধা হয়, তেল-মবিল মাখা প্যান্ট পরলে সে অসুবিধা হয় না।

আমার ক্ষেত্রে অবশ্য এইসব অসুবিধা স্থায়ী হয় না। কারণ আমার সারাদিনের সমস্ত negative charge রাত্রি বারোটার পর আবার discharge হয়ে যায়। তখন আমি আবার ফ্রেস হয়ে যাই। স্বামী বিবেকানন্দ চেতনার এই স্তরে পৌঁছে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে প্রথম থেকেই অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। প্রকৃত তত্ত্বটি অনেকেই জানে না অথচ ছোঁয়া-ছুঁয়ির ব্যাপারে সবাই স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে। তাই স্বামিজী সিংহ গর্জন করে উঠলেন এইসব কুপ্রথার বিরুদ্ধে, নিজেই চণ্ডালের কাছ থেকে চেয়ে তামাক খেলেন। মুচি-মেথর সবাইকে ‘ভাই” বলে সম্বোধন করলেন। এরপর সমাজনেতা হিসাবে গান্ধীজী অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে কিছু আন্দোলন করেছিলেন। তবে এটা জেনে রাখা ভালো যে, স্বামিজীর প্রচেষ্টারই বাস্তবরূপ আজকের এই মানবসমাজ।

জিজ্ঞাসু—গান্ধীবাদে যে অহিংস নীতি দেখা যায়—তা কি বৌদ্ধধর্ম থেকে নেওয়া ?

গুরুমহারাজ—না, জৈনদের অহিংসার সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। বৌদ্ধ অহিংসা আরও bold। জৈনদের অহিংসা কেমন জানতো —ওরা মাথায় উকুন পোষে, একটা উকুন যদি পড়ে যায়, তো আবার সযত্নে সেটিকে মাথায় তুলে দেয়। হয়তো কোন সন্তকে দেখবে আধঘন্টা খটমল সেবা করছে। অর্থাৎ খাটে ছারপোকা আছে, তারা রক্ত খাবে বলে শরীরের কোন বিশেষ অঙ্গ সেখানে ঠেকিয়ে বসে আছে। বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা বুদ্ধির জগতে এতটা হীন কখনোও হয় নি। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা আত্মরক্ষার জন্য ক্যারাটে, কুফু, তাইচি শিখেছে এবং অপরকে শিখিয়েছে। চীনকে একটা সময়, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরাই সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করেছে। তবে বুদ্ধের ৫০০ বছর পর থেকে এই ধর্মের খানিকটা deviation বা চ্যুতি হয়। রাজা-মহারাজারা যখন এই ধর্ম গ্রহণ করল এবং রাজধর্ম হিসাবে বৌদ্ধধর্ম সাধারণের কাছে এল, তখন থেকেই এই ধর্মের বারোটা বাজল। সম্রাট অশোক হয়ে গেল বৌদ্ধধর্মপ্রচারক—কোন বৌদ্ধভিক্ষু নয়, ব্যাপারটা বুঝতে পারছো। সব ধর্মেরই এইভাবে অধঃপতন হয়। যীশুকে যতদিন ওখানকার জেলেরা বা দরিদ্ররা ধরে রেখেছিল ততদিন খ্রীষ্টধর্ম ঠিক ছিল কিন্তু যেই রোমের সম্রাট খ্রীষ্টান হল, তারপর থেকেই ধর্মের আধ্যাত্মিক অধঃপতন শুরু হল। আমাদের দেশেও বিভিন্ন মিশন বর্তমানে Elite Society-র হাতে চলে যাচ্ছে—এটা কিন্তু ধর্মজগতে খুব একটা ভালো লক্ষণ নয়।

এ ব্যাপারে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে একজন মাড়োয়ারি ভক্ত দশ হাজার টাকা দিতে এসেছিল, ঠাকুর নেননি। তৎকালীন যুগে এই টাকার মূল্য ছিল অনেক এবং পরবর্তীকালে টাকার অভাবে সন্ন্যাসী-ভক্তরা কি কষ্টই না করেছিল। তবু বেলুড়মঠ সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা হয়েছে—কোন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এখনকার কর্মকর্তারা অবশ্য সরকারী অনুদান পাবার জন্য নিজেদেরকে সংখ্যালঘু হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে। এই নিয়ে ভিতরে ভিতরে বিরোধও চলছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের Reporter-রা রামকৃষ্ণ মিশনকে শ্রদ্ধা করে তাই এইসব কথা পত্রিকায় ছাপাচ্ছে না। রাজ-অন্নই কদমু এটা বুঝতে না পারাটাই বিভিন্ন সংঘের পতনের কারণ । বৌদ্ধরা তৎকালীন সম্রাটদের সহায়তায় ৪টে সংঘ বানিয়েছিল। তারপর থেকেই বৌদ্ধ সংঘারামগুলোর আধ্যাত্মিক অবনতি ঘটতে থাকে। এইভাবে ভগবান বুদ্ধ বা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এঁরা সবসময়ের জন্যই ঠিক আছেন, কিন্তু পরবর্তীকালে সংঘ কোন ভুল করলে তার মাশুল গুনতে হবে সংঘকেই—ভগবানকে নয়।