জিজ্ঞাসু – রাজত্ব করতে এদেশে এসেছিল বলেই কি ইংরেজরা ভারতে খ্রীষ্টধর্মের প্রসার ঘটাতে পারেনি ?

গুরুমহারাজ—শুধু এটাই নয়—ভারতবর্ষের নিজস্বতাই একে প্রতিহত করেছে। তবু মুসলিমরা বা খ্রীষ্টানরা colony-তেই ধর্মবিস্তার করেছে। তারা প্রথমে সেখানে সৈন্য পাঠাতো, সেই দেশকে জয় করতো, পরে ধর্মযাজক পাঠাতো। এটাই ছিল ওদের style, তাতে রাজত্ব স্থায়ী হোক বা না হোক এরকম করাটাই ওদের স্বভাবে ছিল। এদেশে দায়ে পরে লোকে ধর্মান্তরিত হয়েছে, ভালোবেসে অন্যধর্ম গ্রহণ ক’জন করেছে ? তবে ব্রাহ্ম movement এর সময় ইংরেজরা এই ধর্ম প্রসারকে খুব support করেছিল। ব্রাহ্মধর্মের প্রসারে মুসলিমরাও খুব একটা অখুশি ছিল না। ব্রাহ্মধর্মের কীর্তন ব্যাপারটা মুসলিমরা ঠিক মেনে নিত না, অথচ খৃস্টানদের প্রার্থনার সঙ্গে এটার মিল থাকায় ওরা কিন্তু এটিও মেনে নিয়েছিল। রামমোহন ইংরাজী ছাড়াও আরবি এবং ফারসিতে পণ্ডিত ছিলেন ফলে তৎকালীন মৌলবিরা তাঁকে সাহায্য করেছিল। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যখন পরের দিকে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন তখন তাঁর বক্তৃতা শুনতে অনেক লোকের ভিড় জমতো ৷ উনিও ফারসি জানতেন, ফলে তাঁর জনসভায় মুসলিমরাও আসতো। বিজয়কৃষ্ণ পণ্ডিত লোক ছিলেন, তাই তাঁকে ব্রাহ্মসমাজের আচার্যপদে মনোনীত করা হয়েছিল।

ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে খৃস্টান বা মুসলিমদের ধর্মের মিল থাকায় ওরা এই ভেবে আশাবাদী ছিল যে-ব্রাহ্মরা বীজবপন করুক, ওরা তার ফসল কেটে ঘরে তুলবে। কিন্তু বাদ সাধলেন আট-হাত কাপড়পরা একটা গেঁয়ো বামুন, কৌবর্ত্তদের কালীবাড়ীর পুরোহিত । আট-হাত লাল-পেড়ে কাপড়, তাও আধখানা পরনে আর বাকী আধখানা গায়ে জড়ানো। মুখে চলতি গ্রাম্যভাষা—তাও একটু তোতলামি যুক্ত। তৎকালীন কলকাতার নব্যশিক্ষিত মানুষের কাছে এ হেন ঠাকুরের গ্রহণযোগ্য হওয়াটা খুবই দুরূহ ছিল। ভগবানের লীলায় কি হয় মানুষ তা কিভাবে বুঝবে ! স্বামিজীর মতো লোকও প্রথম প্রথম ‘ঠাকুরই যে ভগবান’ এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন তো তথাকথিত সাধারণ শিক্ষিতরা ঠাকুরকে কিভাবে মানতে পারবে ? স্বামিজীর মনোজগতে যে ব্যাপারটা প্রথম strike করেছিল, তা হলো ঠাকুরের অলৌকিক সরলতা। রাম দত্ত বা দেবেন মজুমদারের বাড়িতে ঠাকুরকে দেখে নরেনের মনে হয়েছিল—লোকটি অলৌকিক সরল।

পরবর্তীকালে কেশব, বিজয়, দেবেন মজুমদার, রাম দত্ত, বৈকুণ্ঠ সান্যালের মতো বিখ্যাত লোকেরা যখন ঠাকুরের কাছে আসা-যাওয়া শুরু করলো, তখন থেকেই সাধারণ মানুষ ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো। কেশব সেন তখন কতো বড় লোক ! তাঁর জ্ঞানগম্ভীর বক্তৃতা যে শুনতো সেই মুগ্ধ হতো। তাঁর মতো লোক বিভিন্ন সভা-সমিতিতে ঠাকুরের সম্বন্ধে বক্তৃতা শুরু করলেন এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর সম্বন্ধে লিখতে লাগলেন, তখন স্বাভাবিক কারণেই সাধারণ মানুষ ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হোল । কেশব সেন ছিলেন উচ্চ আধারের মানুষ। কেশবকে প্রথম দেখেই ঠাকুর বলেছিলেন ‘সবার মধ্যে দেখছি—এনারই লেজ খসেছে’। কিন্তু কেশবের মধ্যে পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক ভাবটি ঠাকুর ঢুকিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের অনেক পরে। কেশবের আধার উন্নত ছিল ঠিকই কিন্তু তাঁর একটু পাণ্ডিত্যের অহংকার ছিল। তাছাড়া ‘কাল’ প্রসন্ন না হলে তো কিছু হবার যো নেই, তাই হয়তো ঠাকুর সময় নিয়েছিলেন। কেশবের বিভিন্ন কার্যকলাপ ব্রাহ্মসমাজের অনেকেই মেনে নিচ্ছিল না। তারা কেশবের বিরুদ্ধে প্রচার করতে লাগলো, বিজয়ের মতো বন্ধুলোকও তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেল। এতে কেশব খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। তার উপরে আবার ঐ সময়েই তাঁর এক খুবই প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটে। এইসব নানান ঝঞ্ঝাটে এবং শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন কেশব। সংসার যেন তাঁর কাছে অসার এবং শূন্য মনে হোতে লাগলো। এই অবস্থায় কি করবেন কিছুই ঠিক করতে না পেরে ছুটে গেলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে। ঠাকুর দেখলেন কেশবের vaccum অবস্থা। অভিমানশূন্য কেশবচন্দ্র সেন শরণাগত হলেন ঠাকুরের কাছে। ব্যস্ আর কি চাই, কথা বলতে বলতে ঠাকুর কেশবকে নিয়ে গেলেন পঞ্চবটীতে। সেখানে গিয়ে তিনি কেশবের বুকে হাত বোলাতে লাগলেন -দিলেন devine touch। বদলে গেলেন কেশব, এরপর থেকে তিনি কিন্তু আর কোন ঝামেলায় জড়াননি। প্রচণ্ড অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন তিনি এবং এরপর থেকে আমৃত্যু তাঁর অধিকাংশ সময় সাধন-ভজন ও কীর্ত্তন নিয়েই কাটতো। রহস্যময় ঠাকুরের লীলা কে বুঝবে ! এই ভাবেই তিনি লীলা-সহচর কেশবের জীবনধারার পরিবর্তন সাধন করে তাঁকে পুনরায় সনাতন ধর্মের আদর্শে সংস্থাপিত করে গেলেন।