জিজ্ঞাসু –আচ্ছা মহারাজ, শ্রাদ্ধকর্মে এখানে কেউ ১০ দিন, কেউ ১৫ দিন, কেউ বা ১ মাস অশৌচ পালন করে –এরূপ পৃথক পৃথক বিধান কেন ?
গুরুমহারাজ—আমাদের বাংলায় চলে স্মাতকার রঘুনন্দনের বিধান। স্মৃতিশাস্ত্র যেন সমাজের সংবিধান। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্মার্তকাররা আছেন যাঁদের বিধান সেই সমাজে চলে। যাইহোক রঘুনন্দনের বিধান অনুযায়ী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের যার যতদিন অশৌচ পালনের নির্দেশ আছে তারা সেইরূপ পালন করে থাকে। তবে বাংলার বাইরে বেশীর ভাগ রাজ্যে সাধারণ মানুষ শুধু মৃত্যুর দিনটাই পালন করে, সেই দিনই দাহ করে স্নান করার পর আর কোন অশৌচ পালন করে না। কেউ হয়তো মস্তক মুণ্ডন করে, কেউ তাও করে না। এর পর দ্বাদশ দিনে শ্রাদ্ধ কর্ম করে এবং কিছু লোকজন বা ব্রাহ্মণভোজন করিয়ে দেয় ।
মুসলিমরা মৃতদেহ দাহ করে না—কবর দেয়। তবে ওদেরও অনেক অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। মৃত্যুর পর মৃতদেহের ‘দফন-কাফন’ হয়, expert দিয়ে পেটের সমস্ত মল বের করাকে ‘দফন’ বলে এবং নতুন কাপড় কিনে এনে মৃতদেহকে ভালো করে ঢাকা দিয়ে ‘কাফন’ করা হয়। এরপর সমাধি বা গোর দেওয়ারও নানান বিধান আছে। মৃতদেহকে স্নান করাতে হয়, বিশেষ নামাজ পড়তে হয়—এছাড়া কোন দিকে মাথা, কোন্ দিকে পা, কে আগে মাটি দেবে, ক’আঁজল মাটি দেবে ইত্যাদি সবকিছুরই বিধান রয়েছে। এসব মিটে গেলে খাওয়া-দাওয়া হয়। এর ৪০ দিন পর হিন্দুদের শ্রাদ্ধের ভোজনের মতো নেমন্তন্ন করে লোকজন খাওয়ানো হয়।
হিন্দুদের মধ্যে বৈষ্ণবরাও মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে দেয়—ওরা একে ‘সমাজ’ দেওয়া বলে। ওরা নুন দিয়ে সমাজ দেয়, আর প্রদীপ দেয় পিছনে। আর খ্রীষ্টানরাও কবর দেয় কিন্তু বাতি দেয় মৃতদেহের সামনে। যাইহোক রঘুনন্দন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সমসাময়িক ছিলেন অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরেই বাঙালীরা রঘুনন্দনের স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান মেনে আসছে। এর মধ্যে কোন বিধান কতখানি বিজ্ঞানসম্মত বা কোনটি কতখানি গ্রহণযোগ্য-এ নিয়ে সমাজে অনেকেই মাথা ঘামায় ফলে কিছু কিছু গ্রহণ-বর্জনও হয়। কিন্তু দেখবে কোন মহাপুরুষ কখনো স্মৃতিশাস্ত্রের বিধানের কোন বিরোধ করেন নি। প্রকৃতপক্ষে এসব নিয়ে তাঁরা মাথাই ঘামান নি। এর কারণ হল আধ্যাত্মিক পুরুষরাই প্রকৃত অর্থে মুক্তপুরুষ। তাই কোন বিধান বা বাঁধনে তাঁরা নিজেরাও আবদ্ধ নন, আর কেউ আবদ্ধ হোক এটাও তাঁরা চান না। তাঁরা শুধু চান মানুষ বাঁধন কেটে বেরিয়ে আসুক, মানুষ মুক্ত হোক। কারণ মানবের পরিপূর্ণতালাভের এটাই অন্যতম প্রধান শর্ত। অপর পক্ষে সমাজপতিরা বার বার কোন না কোন বিধান সৃষ্টি করেছে—সমাজকে সুশৃঙ্খলে রাখার জন্য। কালে যখনই যে সমাজে, যে বিধানে সমাজকে সুস্থ রাখা সম্ভব হয়নি—তা পাল্টে আবার এসেছে নতুন বিধান। একদিন সেটাও পুরানো হয়ে পাল্টে গেছে। এইভাবেই চলেছে সমাজের বিবর্তন। আশার কথা এই যে, এখন দেখা যাচ্ছে সমাজনীতি ক্রমশ ভালোর দিকেই চলেছে।
তবে কথা হচ্ছে যে, সমাজের মূলে যখন মানুষ তখন মানুষের মনকে বিশ্লেষণ না করে শুধু সার্বজনীন কোন নিয়মে বা বিধানে সমস্ত প্রকার মানুষকে কখনই সুশৃঙ্খলাবদ্ধ করা যাবে না আবার সবার মঙ্গলও করা যাবে না। এমনকি একথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, সবাই অর্থাৎ একশ ভাগ লোক কোন একটি নিয়মকে মেনে নিতেই পারবে না তো তাদের মঙ্গল হওয়া দূরের কথা। তাই সমাজবিধান এমন হওয়া উচিত যা মানুষের মনকে বিশ্লেষণ করে তৈরী হয়েছে। মহাভারতের যুগে কৃষ্ণনীতিতে দেখা যায় একই কর্মের জন্য সাম, দান, দণ্ড ও ভেদ এই চার প্রকারের দণ্ডের বিধান ছিল সমাজের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার শ্রেণীর মানুষের জন্য। ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির বা স্বভাবের এবং বিভিন্ন গুণসম্পন্ন মানুষের জন্য বিভিন্ন প্রকার বিধানের ব্যবস্থার কথা ঋষিদের চিন্তায় ছিল। কিন্তু সমাজপতিদের চাপে তা সমাজে চালু করা সম্ভব
হয়নি। আগামীতে যদি কখনো এই ধরণের বিধান চালু হয় তাহলে সমাজের মঙ্গল হবে।