জিজ্ঞাসু –আশ্রমের ময়ূর দুটো অন্য ময়ূরদের থেকে কি পৃথক ? আপনার হাত থেকে মিষ্টি-সন্দেশ খাচ্ছে, অন্য ময়ূররা তো অমন করে খায় না ?
গুরুমহারাজ—এখানে সব পশু-পাখীই অন্যদের থেকে পৃথক । মানুষদের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। আশ্রমের কুকুরগুলো, আমার আসনের কাছাকাছি থাকা পিঁপড়েগুলো, এমনকি আমার ঘরের চালের চড়াই পাখিগুলোও আমার কাছ থেকে প্রচুর মিষ্টি প্রসাদ হিসাবে খায়, এতে ওদের অনেক উপকারও হয়। আর আশ্রমের ময়ূরদুটো অর্থাৎ মুরলী ও পুলিন-এর কথা বলছো তো, দেখো, সাপের বিবর্তনে এসেছে ময়ূর প্রজাতি। তাই সাধারণত সাপ বা অন্যান্য কীট-পতঙ্গ এদের ভক্ষ্য। আমি এখানে সবাইকেই প্রসাদ দিই, ফলে ওরা উপস্থিত থাকলে ওদেরকেও দিই। দেখেছি, সন্দেশ বা নরম মিষ্টি ওরা খুব পছন্দ করে। ময়ূর ভারতের জাতীয় পাখী। এছাড়া এদের বিশেষত্ব হলো এদের সাধারণ রমণ হয় না। শাস্ত্রে কার্তিকের বাহন বলা হয়েছে ময়ূরকে। কার্তিক কুমার, তাই কার্তিকের বাহন। কৃষ্ণের মাথায় ময়ূরপুচ্ছ থাকার তাৎপর্যও এটাই অর্থাৎ তিনি কামকে জয় করেছেন। যোগীর সাথে ময়ূরের খুব সাদৃশ্য রয়েছে। কারণ ময়ূরের যেমন মুখে মুখে রমণ হয় তেমনি যোগীদের রমণ হয় মুখে আর কানে, অর্থাৎ মুখে ব্রহ্মবাক্য কথন আর কানে ব্রহ্মকথা শ্রবণ। এখানে যেন জিহ্বা লিঙ্গ এবং কর্ণ যোনি। যোগীর রমণ চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর— রমণানন্দে বিভোর যোগী। এইভাবেই পরমানন্দ-স্থিতি লাভ করেন।
জিজ্ঞাসু—তাহলে পাখীদের সম্বন্ধেও কত কি জানার আছে— এসব শুনলে অবাক হতে হয় না কি ?
গুরুমহারাজ – অবাক হবার কি আছে – কত পক্ষীবিশারদ আছে পৃথিবীতে, যারা পাখীদের নিয়ে গবেষণা করেই সারা জীবন কাটিয়ে দেয়। গবেষণায় জানা গেছে পৃথিবীতে প্রায় দশ হাজার প্রজাতির পাখী আছে, তার মধ্যে ভারতেই প্রায় দু’হাজার প্রজাতির পাখীর সন্ধান মেলে। পক্ষী-বিজ্ঞানীদের কাছে এটা একটা রহস্য যে, ভারতে কেন এতো প্রকার পাখীর বাস ! শুধু ট্রপিক্যাল দেশ বলে নিশ্চয় নয়, কারণ তাহলে অন্যান্য ট্রপিক্যাল দেশগুলোতেও পাখীর সংখ্যা বেশী হওয়া উচিত ছিল কিন্তু তা হয় না। আমার মনে হয় ভারতবর্ষে এত বেশী বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছপালা রয়েছে এবং সেগুলিতে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ ফুল-ফল জন্মায় যে, এগুলির আকর্ষণজনিত কারণে পাখীরা ভারতবর্ষে বেশী আসে এবং থেকে যায়। এছাড়া পাখীদের উল্লেখযোগ্য আকর্ষণের স্থান হল হিমালয় ।
অনেক পাখী আছে যারা আকাশেই বিশ্রাম নেয়, যেমন—শকুন, আমেরিকার কোঁদড় ইত্যাদি। অনেক glider পাখী তিনমাস পর্যন্ত আকাশেই ভাসমান অবস্থায় থাকতে পারে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মাঝে মাঝে যে হোমাপাখীর উদাহরণ দিতেন, তা প্রকৃতপক্ষে Humming Bird । এরা হয় অনেক উঁচুতে থাকে এবং তুষারকণা খায় অথবা শীতপ্রধান দেশে ভূমির কাছাকাছি থেকে ফুলের মধু খায়। এরা আকারে খুবই ছোট—দুই থেকে তিন ইঞ্চির মতো লম্বা হয়। তাই এদের ডিমও ছোট এবং হালকা হওয়ায় চট করে মাটিতে পড়ে না। ডাহুকিরা জলাশয়ের উপরে বা কাছাকাছি কোন আবর্জনা বা আগাছার মধ্যে ডিম পাড়ে। ডাহুকি ঐ ডিমে তা দেয়। যখন ডিম ফাটার সময় হয় তখন ডাহুকি চিৎকার করে ডাকতে থাকে। ডাকতে ডাকতে যখন ডাহুকির গলা চিড়ে রক্ত বের হয় তখন ঐ রক্ত ডিমে পড়লে তবেই ডিম ফেটে বাচ্ছা বের হয়। সন্তানের জন্য মায়ের রক্ত ঢালা এটাও কিন্তু কম কথা নয়। গ্রামাঞ্চলে হুমো পাখী নামে এক প্রজাতির পাখী দেখা যায়। এরা আকারে বেশ বড় হয় এবং ঝোপঝাড়ওয়ালা বড়ো গাছের কোঠরে বাসা বাঁধে। রাত্রি গভীর হলে এরা দুজনে মিলে এমনভাবে হুম্ হম্ শব্দ করে যে, যে কোন মানুষ হঠাৎ এটা শুনলে মনে করবে, নিশ্চয় দু’জন লোক চুপিসারে কথা বলছে। বহু মানুষ এভাবেই অন্ধকার রাত্রে ভয় পেয়ে থাকে।
পাখীদেরও দাম্পত্য জীবন রয়েছে। কোন কোন পাখী যেমন, হাঁস, মুরগী, ময়ূর এদের দলে একটাই পুরুষ থাকে, সেই দলপতি। অন্য পুরুষ সেই দলে এলে দলপতির সঙ্গে তার মারামারি হয়। পশুদের মধ্যেও হাতি, হনুমান ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে এই একইরকম আচরণ দেখা যায়। তবে বেশীর ভাগ প্রজাতির পাখী তাদের maturity আসার সাথে সাথে সাথী নির্বাচন করে নেয়। বাকী জীবনটা তারা জোড়ায় জোড়ায় থেকে
যায়। খাদ্যগ্রহণ, বাসা তৈরী, বাচ্ছা মানুষ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে। কোন কোন প্রজাতির পুরুষরা অলস, সেখানে স্ত্রী-পাখীরাই এসব কাজের বেশির ভাগটা করে থাকে, আবার কোন কোন প্রজাতির স্ত্রী পাখীর মনোরঞ্জন করতে করতেই পুরুষ পাখীটির বেশির ভাগ সময় অতিক্রান্ত হয়। বিশেষত প্রজননের সময় এই চিত্রটা খুবই দেখা যায়। তবে পাখীদের দাম্পত্য জীবনের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ মানিকজোড় পাখী। এদের মানিকজোড় বলা হয় কারণ এরা সর্বদাই জোড়ায় জোড়ায় থাকে। কোন কারণে যে কোন একটি জোড়ার একজনকে মেরে ফেললে অপরটি সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরপাক খেতে খেতে মৃতদেহের উপর আছড়ে পড়ে মরে যায়। মহর্ষি বাল্মীকি বোধহয় এদেরকে দেখেই ক্রৌঞ্চমিথুন বলেছিলেন এবং এদেরকে নিয়েই পৃথিবীর প্রথম কবিতা উদগীত করেছিলেন।
তবে পাখীদের মধ্যে খুব শান্তিপ্রিয় পাখী ঘুঘু। এরা গোলমাল, হৈ-চৈ একদম পছন্দ করে না। সেইজন্য নিস্তব্ধ দুপুরে এরা প্রাণ খুলে ডাকে। খাদ্যের জন্য মানুষের কাছাকাছি থাকতে এরা বাধ্য হয় বটে, তবে একটি নিরালায় বাসা বাঁধতে চায়। পোড়োবাড়ি বা কোন নির্জন স্থান হলে সেখানে এরা বাসা বাঁধবেই। “ভিটেয় ঘুঘু চরাব’ বলে যে গালি দেওয়া হয় এর অর্থ এটাই। এখানে ঘুঘুর কোন ভূমিকা নেই—পরিবারের সবাইকে মেরে ফেললে বা উচ্ছেদ করলে সেখানে ঘুঘুতে বাসা বাঁধবে। তাই বলা হয় ভিটেয় ঘুঘু চরাব। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে যেন মনে কোর না যে, ঘুঘু কোন অমঙ্গলের প্রতীক। বরং ঘুঘু, শ্বেত পারাবত এদের শান্তির প্রতীক বলেই ধরা হয়। খ্রীষ্টানরা তো ঘুঘুকে *খুবই মর্যাদা দেয়।