জিজ্ঞাসু—তাহলে জলচর প্রাণীদেরও নিশ্চয়ই নানান বৈচিত্র্য আছে ? মাছেদের বৈচিত্র্য সম্বন্ধে যদি দয়া করে কিছু বলেন ?

গুরুমহারাজ—মাছ নিয়ে আগে অনেক আলোচনা হয়েছে, হয়তো তখন তুমি ছিলে না। মাছেদের জগতও খুবই বৈচিত্র্যময়। জলের বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বাস করে। সেই অনুযায়ী তাদের শারীরিক গঠনের পরিবর্তন হয়। ওদের জগতেও উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ আছে। যেমন ধর রুইমাছ, এরা যেন মাছেদের জগতে উচ্চশ্রেণীর লোক বা রাজা। এক এক প্রজাতির মাছ সাধারণত দল বেঁধে এক এক বিশেষ স্থানেই থাকে। রুইমাছ যেহেতু বিশেষ সম্মানীয় বা উচ্চশ্রেণীর, তাই সে এইরকম যে কোন দলে বা যে কোন স্থানে যেতে পারে। এতে সেই মাছের দল কিছু মনে করে না বরং গর্বিত হয়। কিন্তু ল্যাঠা প্রজাতির মাছ অন্য কোন দলে এমনকি গভীর জলের দিকে যেতেই পায় না, অন্য প্রজাতির মাছেরা এদেরকে অচ্ছুৎ মনে করে তাড়িয়ে দেয়। তাই দেখবে এরা অগভীর জলে বা ডাঙার কাছাকাছি ঘুরে বেড়ায়।

কাতলা প্রজাতির মাছ জলের উপরের স্তরে থাকে, এরা একটু বাবুগোছের। সামান্য অসুবিধা হলেই এরা কাতর হয়ে পড়ে। কোন কারণে পুকুরের জল ঘোলা করলে কাতলা মাছ আগে মারা যায়। কুয়াশা হলে বা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে এদের কষ্ট হয়, পুকুরে খাবি খায় অর্থাৎ ভেসে ওঠে, অনেক সময় মারাও যায়। মাগুর, শিঙি—এরা যেন মাছের জগতে পুলিশ। ফলে এরা নির্ভয়ে যখন যেখানে খুশি বিচরণ করে। অন্যেরা ভয়ে ভয়ে এদের বিচরণের জন্য স্থান ছেড়ে দেয়। বোয়ালমাছ যেন মাছের জগতে গুণ্ডা। অন্য প্রজাতির মাছেরা একে ভীষণ ভয় পায়, তাই এদেরকে ভয়ে ভক্তি করে। তবে বোয়াল এবং মৃগেল কিন্তু অত্যন্ত চালাকমাছ। জালকে ফাঁকি দিতে এরা সিদ্ধহস্ত। পুকুরে জাল নামলে, অন্য মাছেরা ভয়ে কাতর হয়, কিন্তু এরা হাসে. চুপ করে কাদায় মুখ লাগিয়ে এক জায়গায় অপেক্ষা করে, তারপর জালটা যেই পিঠের উপর দিয়ে pass হয়ে যায়— এদের আনন্দ দেখে কে ! তবে বোয়াল ধরার উপায়ও মানুষের জানা আছে—একেবারে অব্যর্থ উপায় । জলাশয়ে যদি একটা মাত্র বোয়াল থাকে সেটাও এই উপায়ে মারা যাবে। করা হয় কি—একটা ডিমের খোলা নেওয়া হয়, যার মুখটা খুব সরু করে ফাটানো। তার ভেতর শক্ত সুতোসমেত মজবুত বড়শি আর গোটাদুয়েক জোনাকি পোকা ঢুকিয়ে দিয়ে মুখটা ময়দার আঠা দিয়ে seal করে দিতে হয়। এবার লম্বা শক্ত সুতোর সঙ্গে জুড়ে বড়শিসমেত ডিমের খোলাটি ঐ জলাশয়ে ছেড়ে দিতে হবে রাত্রিবেলায়। অন্য কোন উপচার দরকার নেই, ডিমের খোলা ভাসলেই ভিতরে থাকা জোনাকির আলো মাঝে-মাঝেই জ্বলবে, আর ঐটা দেখে বোয়ালমাছ হাঁ করে ছুটে এসেই ওটা গিলবে। ব্যস্, সুতো আর বঁড়শি যদি টেকে তাহলেই বোয়াল নিধন হয়ে গেল।

কইমাছ ধরা হয় কিভাবে জানতো – কঞ্চি বা বাঁশের ছোট ছোট সরু সরু ইঞ্চি চারেক লম্বা মত কাঠি তৈরী করতে হয়। যেগুলো বাঁকিয়ে দু’মুখ এক জায়গায় করলেও ভাঙ্গবে না আবার ছেড়ে দিলেই তা সোজা হয়ে
যাবে। এবার ঘুরঘুরে পোকা ধরে তার ধড়টা pieces করে করে পাঁচ-ছয় টুকরোয় ভাগ করতে হবে, এগুলো গোল গোল ring-এর মত হয়ে যাবে, এবার এক-একটা piece ঐ কাঠিগুলোর দু’মুখ একজায়গায় করে ঢুকিয়ে দিয়ে জলে ভাসিয়ে দিতে হবে। এরকম পুকুরের ধারে ধারে এমাথা থেকে ওমাথায় কয়েকটা দিতে-দিতেই দেখা যাবে যে, প্রথমদিকে গোটাকয়েক কইমাছ লেগে বসে আছে। এতে কোন সুতোর দরকার নেই—হবে কি, দু’মুখ একজায়গা করা ঐ কাঠিটা থেকে ঘুরঘুরের piece টা যেই কইমাছটি খেয়ে নেবে অমনি কাঠিটা সোজা হয়ে মাছটির দু’দিকের চোয়াল ফাঁক করে আটকে থাকবে। এতে কই মাছটা এমন কাবু হয়ে পড়বে যে, সে ডুবতেও পারবে না—নড়বেও না, চুপ করে পড়ে থাকবে। তখন টপাটপ ধরে নিলেই হল। ট্যাংরামাছ ধরতে হয় ল্যাঠামাছ পোড়া দিয়ে। ল্যাঠামাছ পুড়িয়ে শুকিয়ে গুঁড়ো করে পুকুরের এক জায়গায় ছড়িয়ে দিলেই—যত ট্যাংরা ঐ জায়গায় জড়ো হবে। তখন জাল দিয়ে ধরে নেওয়া যায়।

বর্তমানে সিলভারকার্প, গ্রাসকার্প জাতীয় উচ্চফলনশীল মাছ বাজারে খুবই আমদানি হয়েছে। এরা প্রচণ্ড বাড়ে, গ্রাসকার্প লতা- পাতা, দাম-দল, শ্যাওলা ইত্যাদি যা পায় তা-ই খায়, তাই এদের এতো বৃদ্ধি। তবে হাইব্রিড জাতীয় যে কোন খাদ্যই শরীরে effect করে। সেই অর্থে আগেকার দেশী মাছ খাওয়াই শরীরের পক্ষে ভাল। তবে যে মাছেদের কথা আলোচনা করা হ’ল—সেগুলি মিষ্টি জলের মাছ। সমুদ্র যেমন বিশাল,সামুদ্রিক মাছেদের বৈচিত্র্যও তেমনি বিশাল, এ আলোচনা অন্য কোন দিন হবে।