স্থান:–বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন, সময়_১৯৯৭ সাল।
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:—জয়দীপ,গঙ্গাবাবু, বনগ্রাম আশ্রমের মহারাজগণ ও বহিরাগত কিছু ভক্ত!
জিজ্ঞাসু:—আজকাল জীবনমুখী গান বা জীবনের গান বলে যেগুলি আমরা শুনছি সেগুলি কি সত্যই জীবনমুখী গান?
গুরু মহারাজ:—-দ্যাখো, প্রকৃতপক্ষে ‘জীবনের গান’ বলতে যে সংগীতের কথা আমার মনে আসে, তা হোল “বাউল গান” ! বাউল গানের প্রতিটি ছন্দে জীবনকে আলিঙ্গন করতে শেখায়, আবার প্রতিপদে মৃত্যুকেও মনে পাড়ায় ! ফলে, এমন গান‌ই তো প্রকৃতপক্ষে “জীবনের গান” হওয়া উচিত_তাই নয় কি!
জন্ম, জীবনকাল ও মৃত্যু এই তিনটি দশা নিয়ে সমস্ত জীব সহ মানুষের জীবন। আর জীবনের আধার দেহ বা শরীর ! বিবেক এবং বুদ্ধি হোল এই জীবনের চালক, আর মানুষের মন হোল জীবনের বাহন ! দেখবে এইজন্যেই বাউল গানে ‘মন পবনের নাও’, ‘মন মাঝি’– এইসব শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ রয়েছে! আর শরীরকে ‘হাড়-মাংসের খাঁচা’, ‘মাটির দেহ’, ‘দেহ পিঞ্জর’ ইত্যাদি শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে! বেশিরভাগ বাউল গানে রুপকাকারে দেহতত্ত্বকেই বোঝানো হয়। দেহ-মন-প্রাণের পুঙ্খানুপুঙ্খ তত্ত্ব বা তথ্য একমাত্র বাউল গান ছাড়া আর কোথায় পাবে বলো? তবে সুর করে গাব্ গুবা গুব্ বাজিয়ে বা একতারা-দোতারা বাজিয়ে, নেচে নেচে গান গাইলেই যে সেগুলি সব বাউল গান __তা কিন্তু নয়! সেগুলিকে ‘লোকগীতি’, ‘মাটির কাছাকাছি গান’ _এই সব বলা যায়, কিন্তু বাউল গান বলা যায় না ! একমাত্র মহাজ্ঞানী মহাজনেরাই সঠিক বাউল গান রচনা করতে পারেন! আধ্যাত্মিক গুরুরা তাঁদের শিষ্য পরম্পরায় আধ্যাত্মিকতত্ত্বের যে জ্ঞান বা শিক্ষা দেন সেগুলোই যখন গানে রূপ পায় অর্থাৎ সেইসব শিক্ষা গানের মাধ্যমে পরিবেশিত হয় সেইগুলিই বাউল গান! সেই অর্থে বাউল গান গাওয়া টাও সাধনা, আবার বাউল গান শোনাটা ও সাধনা ! কোনো show করা বা পয়সার জন্য আলোকমালায় সুসজ্জিত স্টেজে গান গাওয়াটা প্রকৃত বাউলের কাজ বা উদ্দেশ্য নয়।
বাউল গানের আরেকটা বড় দিক হোলো __একমাত্র বাউলগানেই, ছত্রে-ছত্রে জীবনের পাশাপাশি মৃত্যুকে মনে পাড়ায়!মৃত্যুকে বাদ দিয়ে তো জীবন নয় ! জীবন আর মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়টুকুই জীবের জীবনকাল ! কিন্তু সেই মধ্যবর্তী ফাঁকটুকু, কার ক্ষেত্রে কতটা অর্থাৎ জীবনকাল বা আয়ু কার কতটা __তা কি কেউ জানে ? আর জানে না বলেই তো বহুকাল থেকে মানুষ ছুটেছে গণৎকারের কাছে, সিদ্ধ সাধকের কাছে ! মানুষ জানতে চায় সে কতদিন বাঁচবে ! 40 বছর ? 50 বছর ? 60,70 বা 80 বছর ? যে যতদিন বাঁচবে, সে ততো বেশি ভোগ করতে পারবে _ সাধারণ মানুষ এটাই চায়! ভোগ-ঐশ্বর্যের মধ্যে জীবন কাটাতে ! কিন্তু এর প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো তার জীবনকাল বা আয়ু!
সেইটাই সাধারণ মানুষ জানতে পারে না_সবাই ভাবে যে সে আরো বহু কাল বেঁচে থাকবে ! কিন্তু যে কারো জীবন ও মৃত্যুর পার্থক্য মাত্র মুহূর্তকাল হোতে পারে _সেইটা মানুষের মনে থাকে না বা বলা ভালো, মানুষ সেটা মনে রাখতে চায় না ! কারণ মৃত্যুকে ভয় পায় মানুষ ! অথচ মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী, তাকে এড়ানো‌ও যাবে না! তবু মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়_মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চায় না, এড়িয়ে চলতে চায়! এই জন্যই জ্ঞানী -গুনীরা সাধারণ মানুষকে ‘অজ্ঞানী’ বলেছেন। সদা-সর্বদা যিনি মৃত্যুকে খেয়াল রাখতে পারেন তিনিই জ্ঞানী! কথিত রয়েছে, মহাজ্ঞানী আচার্য শংকর পথ চলতে চলতে মৃত্যুর দেবতার সাথে কথা বলতেন!
সাধারণ মানুষ অজ্ঞানী,কারণ সে মৃত্যুকে ভয় পায়! আর তাইতো তাদের প্রিয় গান হোলো__ তাদের‌ই জীবনের গান-তাদের দৈনন্দিন জীবন-যাত্রার গান ! এইগুলোই তারা গাইতে বা শুনতে ভালবাসে! কিন্তু সেই গানগুলিতে কি পাবে__ শুধু দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের কিছু কথা আর হৈ-হুল্লোড়,মস্তি-মৌজ-স্ফূর্তির কথা, সেই অনুযায়ী সুর, সেই রকম যন্ত্রসংগীত! অপরপক্ষে একজন বাউলকে দেখবে, হয়তো সে কোনো নির্জন স্থানে একাকী অথবা দু-চারজনে বসে একতারা বা দোতারা বাজিয়ে আপনমনে আনন্দ করে একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছে! কেউ শুনছে কিনা অথবা কেউ বাহবা দিচ্ছে কিনা __এই নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা‍ই নেই! সে আত্নানন্দে ভরপুর! হয়তো ভিক্ষা করে খায়, পর্ণকুটিরে বাস করে,নিজের হাতে সেলাই করা পোষাক পড়ে,নিজেই দুমুঠো অন্ন ফুটিয়ে নেয়, আর সেই অন্নভোগ ঈশ্বর বা আল্লাহকে নিবেদন করে তার প্রসাদ হিসাবে সেই অন্ন খায়! কিন্তু সদাই আনন্দে থাকে বা থাকার চেষ্টা করে! কারণ আনন্দের উৎসে যাওয়াটাই তো বাউল-সাধনার মূল!
বাউলেরা জীবনের গভীরে ঢুকে জীবনের তত্ত্বকে খুঁজে পায়! আর সাধনার স্তর অনুযায়ী_যে যতটা পায়,সে সেটাকে নিয়েই গান বাঁধে! তাঁর গান অর্থাৎ তাঁর শিক্ষা পরম্পরাক্রমে শিষ্যদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়__এইভাবেই বিভিন্ন বাউল পরম্পরাগুলি চলে আসছে! এদের সবাই যে সিদ্ধ বাউল তা নয়,সিদ্ধ বাউলদের রচিত গান শুনলেই বোঝা যায়!
আর তুমি যা বলতে চাইছো_অর্থাৎ আধুনিক ব্যান্ডের গান বা ঐ ধরনের গানগুলি যত‌ই জীবনমুখী গান বলে চালানোর চেষ্টা করা হোক না কেন_এগুলি ‘জীবনের গান’ নয়! এই গানগুলিতে তুমি হয়তো জীবনের দুটো-একটা দিকের কথা, দুটো-একটা সমস্যার কথা পাবে কিন্তু সম্পূর্ণটা কখনোই পাবে না!
জন্ম~জীবনকাল~মৃত্যু, জীবনের আধার, জীবনের অবলম্বন, জীবনের পরিণতির কথা বাউল ছাড়া আর কে বলতে পারে! জীবনের বাস্তবতা এবং প্রকৃত সত্যের সঙ্গে পরিচয় করায় বাউল_তার বাউল সঙ্গীতের মাধ্যমে! তাই আজকাল যেগুলিকে ‘জীবনমুখী গান’- বলা হচ্ছে ওগুলি প্রকৃত‌অর্থে ‘জীবনমুখী গান’ নয়। এরা part of life-এর কথা বলে __জীবনের সম্পূর্ণটাকে তুলে ধরতে পারে না!
অনেকে রবীন্দ্রনাথের গানকেও ‘চিরকালীন গান’, ‘মানুষের জীবনের গান’ __ইত্যাদি বলে থাকে! যেহেতু রবীন্দ্রনাথ জীবনের ছোটখাটো, খুঁটিনাটি প্রায় সমস্ত বিষয়কেই তাঁর সাহিত্যে বা সঙ্গীতে আনার চেষ্টা করেছেন। মৃত্যুকে জয় করে মৃত্যূঞ্জয় হোতেও তিনি চেয়েছিলেন! কিন্তু দেহতাত্ত্বিক সাধন জগতের জ্ঞানের জায়গাটা প্রথমদিকে তাঁর ছিলনা। এই অসম্পূর্ণতাটা