জিজ্ঞাসু :— দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মে সাপকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতীক বোঝাতেও সাপের চিহ্ন খুবই ব্যবহৃত হয় ! এমনও শোনা যায় যে, বিভিন্ন যোগীর শরীরেও নাকি সাপ অবস্থান করে। আবার কেউ কেউ দেখেছে যে, আপনার ঘরের সামনে নাকি অনেক যোগীপুরুষ ‘সাপ শরীরে’ রয়েছে—এই সবকিছুর পিছনে রহস্যটা কি ?

 গুরুমহারাজ :-- তুমি স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত বেলুড় মঠে বা উদ্বোধন পত্রিকায় যে একটা প্রতীক রয়েছে—ওইটা দেখেছো বোধহয় ! যাইহোক, একটা কথা তুমি ঠিকই বলেছো_যে বিভিন্ন ধর্মীয় চিহ্নে সাপের ব্যবহার রয়েছে, সাপকে প্রাধান্য‌ও দেওয়া হয়েছে। তবে আর একটা কথা ভুল বললে_কথাটা 'বিভিন্ন ধর্মে' নয়, ওটা ''বিভিন্ন ধর্মমতে" _হবে। । 

ধর্মীয় ক্ষেত্রে সাপকে প্রাধান্য দেবার প্রধানত দুটি কারণের একটা হোলো_ সাপ গতির প্রতীক। সাপের আঁকাবাঁকা সর্পিলগতিকে যেমন কেউ কেউ কুটিল গতি বলেছে, তেমনি পদার্থবিজ্ঞানে এই ছন্দকেই গতির স্থুলরূপ হিসাবে দেখানো হয়েছে। যে কোনোরকম গতি বোঝাতে graphically তুমি ঐ চিত্রটাই পাবে। সাধকের বা যে কোনো ব্যক্তির জীবনে সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন, ভালো সময়-খারাপ সময় ইত্যাদি ঐরকম‌ই graphicall চিত্রের ন্যায় আসবে। মানুষ নিজের বুদ্ধি বিচারের দ্বারা বুঝতে পারে যে, জীবন‌ও গতিশীল কারণ গতির ধর্মই হোচ্ছে একবার উপরে একবার নীচে অথবা একবার ডাইনে একবার বামে ধাবিত হওয়া !

সুতরাং মাভৈঃ ! প্রতিটি মানুষের জীবনে যখন উত্থান পতন রয়েছে তাহলে অবশ্যই জীবন গতিশীল, মানুষের মন‌ও গতিশীল। তাহলে যেখানে গতি রয়েছে সেখানে আবার ভাবনা কি ! যা থেমে গেছে, স্থিরতা প্রাপ্ত হয়েছে _তার‌ই ঘটেছে মৃত্যু ! মানুষ ও একটা ভাবনায় অথবা কোনো একটা বদ্ধ ধারণায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে _ তখন তার চেতনার অগ্রগতির অপমৃত্যু ঘটে। আবার কোনো মহাপুরুষ পিছনে 'ঘা' না লাগানো পর্যন্ত সে ঐখানেই ঘুরতে থাকে।

 সাধকের জীবনে আদ্যাশক্তিরূপিণী কুলকুণ্ডলিনী মূলাধার চক্রে সর্পিলাকারে জড়িয়ে জড়িয়ে নিদ্রিত থাকে। সাধনার দ্বারা তাকে জাগ্রত করতে পারলে এবং তার মধ্যে গতির সঞ্চার করতে পারলে সাধক চরৈবেতির সোপান ধরে এগিয়ে চলে পূর্ণত্বের দিকে। শাস্ত্রকারেরা ঐ কুলকুণ্ডলিনীকে বোঝাতে সাপের আকারকে নিয়েছেন, স্বামী বিবেকানন্দও তাই করেছেন।

তবে সাপের যে কুটিল গতি এবং তার যে ছিদ্র বা গর্ত অথবা ফাটল খোঁজার স্বভাব__ এটা বেশিরভাগ মানুষেরই স্বভাবের সঙ্গে মেলে। সাধারণতঃ মানুষও সহজ-সরল হোতে পারে না, নিজেকে জটিল বা কুটিল করে তোলে আর সদা-সর্বদাই অপরের ছিদ্র বা দোষ খোঁজে। এইটাকে বলতে পারো মনের ‘সরীসৃপ’ অবস্থা। অর্থাৎ বিবর্তনে শরীরটা মানুষের মতো হোলেও মনোজগতে তারা এখনও সরীসৃপ রয়ে গেছে, শুধু আঁকাবাঁকা পথে হাঁটছে আর পরের ছিদ্রান্বেষণ করে বেড়াচ্ছে !

  বিভিন্ন মহাপুরুষের 'সাপ' শরীরধারণের ব্যাপারটারও উত্তর পাবে ঐ দিয়ে বিচার করলে। যে যে রঙের চশমা পরে আছে, সে তো জগতকে ঐ রঙেরই দেখবে। কোনো মহাপুরুষের শরীরকে একজন সরীসৃপ দেখছে ! এর মানে হোচ্ছে যে, সে সেই চেতনায় রয়েছে ! উন্নত চেতনার মানুষ হোলে সে চেতনার চক্ষু দিয়ে ঐ যোগীকে দিব্যশরীরধারী মহাপুরুষই দেখবে।