জিজ্ঞাসু :— গুরুমহারাজ ! কিছুদিন আপনি চাকুরি করেছিলেন, এর পিছনে কি কোনো বিশেষ কারণ ছিল ?

গুরুমহারাজ :-- হ্যাঁ, আমি ২ বছর ৭ মাস মতো রুরাল ইলেকট্রিফিকেশনের কাজে কন্ট্রাক্টরের আণ্ডারে চাকরি করেছিলাম। এটা করার পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল, তবে মোটামুটিভাবে প্রথম কারণ হিসাবে বলা যায় যে —আমার গর্ভধারিণীর প্রতি কর্তব্য পালন করা। কারণ তখন আমাদের সংসারে খুবই অভাব ছিল। আমার ভাইয়েরা ছোটো(বড় ভাইয়েরা separate থাকতো), বোনেদের তখনও বিয়ে হয়নি, এমত অবস্থায় আমি যদি রোজগার না করতাম তাহলে মাকে চরম অভাব ও অশান্তির মধ্যে থাকতে হোতো। সেই জন্যেই আমি মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালাম। আমার ঐ চাকরিতে join করার পর থেকে মাকে কখনই দুটো মোটা- ভাত-কাপড়ের জন্য ভাবতে হয়নি ! কিছুদিন পরে বোনেদের‌ও বিয়ে হয়ে গেল_ ছোটো ছোটো ভাইয়েরাও একটু বড় হয়ে গেল। তখন আমি মায়ের অনুমতি নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিলাম এবং ছোটো পরিবার ছেড়ে বিশ্বব্রহ্মান্ডরূপ বৃহৎ পরিবারের কাজে যোগ দিলাম।

  আমার চাকরি করার অন্য আর একটা উদ্দেশ্য ছিল আমার যারা সঙ্গী-সাথী—যারা পরবর্তীকালে আশ্রমের কাজ করবে বলে নির্দিষ্ট হয়ে আছে__ তাদের কাছে পৌঁছানো ! তাদেরকে জন্মগ্রহণের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি তা মনে করিয়ে দিয়ে _তাদেরকে কাছে টানা ! কারণ তারা তো মায়ার জগতে এসে মহামায়ার মোহিনী মায়ায় নিজেদের জন্মগ্রহণের উদ্দেশ্য বা অন্য সব কিছু বিস্মৃত হয়ে ছিল !   

 আর এগুলি ছাড়াও, পরবর্তীতে যে সব স্থানে  আশ্রমের শাখাকেন্দ্র হবে বা সেই স্থানগুলিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ হবে সেসব স্থানের জনমানসে তো একটা প্রভাব ফেলা প্রয়োজন ছিল‍ই ।কারণ লোকসংগ্রহ না করলে কাজ হবে কি করে ?

  এইভাবে বর্ধমান, বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলার বিভিন্ন স্থানে আমাদের কোম্পানীর কাজ হয়েছিল এবং কাজের মাধ্যমে উক্ত বৃহৎ উদ্দেশ্যগুলিও সাধিত হয়েছিল। ঐ স্থানগুলি থেকেই অধিকাংশ ত্যাগী সন্তানদের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিল এবং তারা আশ্রমে চলে এসেছিল।। আর আমি যেসব অঞ্চলে তখন দেখেছিলাম_ পরমানন্দ মিশনের শাখা আশ্রমসমূহের অনেকগুলিই ঐ সব স্থানে তৈরি হয়েছে। স্বরূপানন্দ আর চিদ্‌বিলাসানন্দ এরা আমার মামার বাড়ীর সম্পর্কের লোক। ওরা যেন divine plan এ কে কে যাবে জিজ্ঞাসা করতেই আগে হাত তুলেছিল, তাই ছোটবেলা থেকেই যোগাযোগ।           স্বরূপানন্দ স্থুলদেহের বিচারে আমার থেকে এক-আধ বছরের বড়ই হবে কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার বন্ধু। সেই সময় আমি মামার বাড়ী গেলে এবং ও কৃষ্ণদেবপুর এলে ওর সাথে জমিয়ে খেলা করতাম। ছোটবেলা থেকেই দু'জনা দু'জনকে নতুন নতুন  নামকরণ করে রাগাতাম। বড় হয়েও ওর সাথে চিঠি-পত্রে যোগাযোগ ছিল, তারপর প্রথমে স্বরূপানন্দ এবং কয়েক বছর পরে চিদবিলাসানন্দ এখানেই চলে এলো।

  যাইহোক, আমি যখন হিমালয় থেকে এখানে ফিরে এলাম, তখন ভাবলাম আমাকে কে চাকরি দেবে ? কারণ আমার তো সার্টিফিকেট নেই, আর একমাত্র লেবারের চাকরিতেই সার্টিফিকেট লাগে না !  তাই সেই সময় ইলেকট্রিক ডিপার্টমেন্টে প্রচুর কাজ হচ্ছে দেখে, ওখানেই ঢুকে গিয়েছিলাম। তখন ইন্দিরা গান্ধীর আমল, ইমার্জেন্সি পিরিয়ড চলছিল। ফলে কাজ পেতে অসুবিধা হয়নি।

 আমার ত্যাগী সন্তানদের মধ্যে তৃষাণকে বশে আনতেই আমাকে বেশী বেগ পেতে হয়েছিল, তবে মিহিরও কিন্তু কম বদ ছিল না। তৃষাণের সঙ্গে আলাপ হবার পর থেকেই একে একে দেবেন্দ্রনাথ, সম্বিৎ, রায়নার জগাদা-হারু,  বনগ্রামের মুখার্জী বাড়ীর ন’কাকা, হরি, দীপ্তি, তপী_ ওদিকে জগাদার শ্বশুর বাড়ীর সম্পর্কে মুরারী, শংকরানন্দের সূত্র ধরে সিঙ্গুরের ভক্তবৃন্দ এবং অনুপ বা ওদের বাড়ীর লোকজনের সঙ্গে দ্রুত আলাপ হয়ে গিয়েছিল।

 সিঙ্গুরে অনুপ মহারাজ অর্থাৎ পূর্ণানন্দের মা-ই আমাকে তিনদিন অনাহারের পর প্রথম অন্ন খেতে দিয়েছিল। সেই থেকেই আমি ওনাকে 'জননী' বলে সম্বোধন করি।    

 যাইহোক ঐ যে বললাম—'এক এক করতে করতে অনেক'—এই ব্যাপারটার একটা বিজ্ঞান রয়েছে। মূল কেন্দ্রে যেতে না পারলে যেমন গোলকধাঁধায় ঘুরে মরতে হয়--- যেমন কোন জট ছাড়াতে গেলে মূল গিঁটটা খুললেই সব খুলে যায়, তেমনি মধ্যমগ্রামে Camp-এর কাজ শুরু হবার পর থেকেই দ্রুত আমার ভবিষ্যৎ আশ্রমজীবনের পরিকাঠামো তৈরি হোতে আরম্ভ হয়েছিল। তৃষাণ হোচ্ছে পরমানন্দ মিশনের মুল খুঁটিস্বরূপ। ও যদি কোন কারণে কাজ বন্ধ করে দেয়, আমার Project-ই ফেল হয়ে যাবে—সেইরকম কিছু হোলে হয়তো আমি কাজ বন্ধ করেই চলে যাবো। আর মুরারী হোচ্ছে আশ্রমের মা–সবসময় নিষ্কামভাবে কর্ম করে চলেছে।।