জিজ্ঞাসু :– তাই নাকি ? এইরকম ব্যাপার ? যাইহোক শুনেছি আপনার কর্মজীবনে নানান অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে— সে সবের সাক্ষীও অনেকে রয়েছে ! ঐ ঘটনাগুলির দু-একটা যদি বলেন !
গুরুমহারাজ :---দ্যাখো, এর আগে তো আমি তোমাদের বারবার বলেছি—সার্বজনীনভাবে 'অলৌকিক' বলে কিছু হয় না, তোমার কাছে যা অলৌকিক অন্যের কাছে তা লৌকিক। তবু 'অপার্থিব', 'অলৌকিক' ইত্যাদি শব্দ বা ঘটনার প্রতি মানুষের চিরন্তন একটা কৌতুহল থেকেই যায়। তোমাদের কাছে তাহলে মানুষটা বড় কথা নয়, বড় কথা হোলো তার জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী— বোঝ একবার কাণ্ডটা !!
‘অলৌকিক’ শব্দটার ইংরাজী প্রতিশব্দ Miracle, যা সংস্কৃত মূল শব্দ ‘মায়া’ থেকে নেওয়া হয়েছে। ইউরোপে Miracle শব্দটি আবার পরিবর্তিত হয়ে ‘Magic’-এ রূপ নিয়েছে। ফলে Magic এবং Miracle এই শব্দ দুটোর মূল উৎস সংস্কৃত ‘মায়া’ শব্দটি।
যাইহোক, আমার কর্মজীবনের দুটো ঘটনার আমি উল্লেখ করছি, যেগুলি তোমাদের কাছে 'অলৌকিক' মনে হোলেও সত্যি সত্যিই আমি ঐ ঘটনাগুলির তাৎক্ষণিক কোনো ব্যাখ্যা পাইনি। যে কোনো কার্যেরই কারণ থাকে, কিন্তু ঐ ঘটনাগুলি যেন অহেতুক ঘটে গেছিল আমার জীবনে। আর ঘটনাগুলি ঘটার পিছনে যদি কোনো কারণ থাকেও তা ঘটনাগুলির তুলনায় এতো নগণ্য যে, ওগুলিকে 'কারণ' হিসাবে মেনে নেওয়াও মুস্কিল।
একটা ঘটনা ঘটেছিল বর্ধমান জেলার দামোদর পারে চক্ষণজাদীর নিকট শম্ভুপুর গ্রামে। তখন ঐ গ্রামে ‘ইলেকট্রিক পোল’ পোঁতার কাজ চলছিল। প্রথমদিন কোথায় কোন পোল’টি বসবে তার মেজারমেন্ট হয়েছিল, তখন গ্রামবাসীরা কোনো ব্যাপারেই কোনোরূপ ওজর-আপত্তি তোলেনি। পরের দিন যখন আমার লোকেরা পোলের মাপ অনুযায়ী রাস্তার উপর ঝুঁকেপড়া ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে গেছে, তখনই লেগেছে গোলমাল। কারণ ঐ রাস্তার উপরে এমন একটা গাছ ছিল যেটা গ্রাম্য-দেবতার স্থানে প্রতিষ্ঠা-করা গাছ। কোম্পানীর কাজে ‘জয়েন্’ করার কিছুদিন পরই উপরওয়ালারা আমাকে শ্রমিকদের Superviser করে দিয়েছিল, ফলে আমারই নির্দেশে লোকগুলি অন্যান্য গাছের ডালের সঙ্গে ঐ গাছের ডালও কেটেছে। আর যায় কোথায় ! গ্রাম্য-সেন্টিমেন্ট! প্রতিষ্ঠা করা গাছের ডাল কাটবে কেন ? জানো তো _ দামোদর পারের ঐ সমস্ত গ্রামগুলির জনগণ ভীষণ উগ্র। যদি দুজনের মধ্যে কোনো গণ্ডগোল বাধতো__তাহলে গ্রামের লোক জেনে যেতো যে, ওদের মধ্যে কেউ একটা খুন হবে না হয় জখম হবেই হবে। সামান্য ঝগড়ঝাঁটি হোলেই একপক্ষ সুযোগ পেলে অন্যপক্ষের লোককে মেরে একেবারে দামোদরের চরে পুঁতে ফেলতো। এখন অবশ্য ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হয়েছে, আর সেই পূর্বের অবস্থা নেই কিন্তু তখন (১৯৭৬-৭৭) ছিল।
যাইহোক, তখন গ্রামের বেশ কিছু লোক মিলে আমাদের লোকগুলোকে মেরেই ফেলবে এমন ভাব নিয়ে লাঠি, টাঙ্গি এসব নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে হাজির ! আমার লোকগুলি তো ভয়ে অস্থির, ওরা তখন বলেছে, 'আমাদের কি দোষ, রবীনদা অর্ডার দিয়েছে তাই কেটেছি। রবীনদা আমাদের সুপারভাইজার, একটু অপেক্ষা করো উনি এখনি আসবেন'। এইকথা শুনে জনগণের সমস্ত রাগ ওদের উপর থেকে সরে গিয়ে আমার উপরে পড়ল। আমার লোকগুলোকে এক জায়গায় আটকে রেখে গ্রামবাসীরা সকলে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষায় আছে—আমি এলেই ওরা আমাকে কচুকাটা করবে ! আমি অন্যান্য ফিল্ডের কাজ দেখে সাইকেল চালিয়ে ঐ ফিল্ডের কাজ কতোটা এগোলো__ তা দেখতে শম্ভুপুর যাচ্ছিলাম। আমি তো ঘটনার কিছুই জানি না, ফলে আমি আপনমনে ফুল স্পীডে সাইকেল চালিয়ে ওদের কাছাকাছি চলে গেছি ! দূর থেকে অবশ্য দেখেছিলাম যে, বেশকিছু লোক এখানে-ওখানে বসে আছে। এবার তাদের হাতে যে অস্ত্রশস্ত্র আছে বা তারা আমাকে মারার জন্য বসে আছে – তা কি করে জানবো বলো দেখি ! আমি ওদের একেবারে কাছাকাছি চলে গেছি দেখে তারা চাইছিল দূর থেকেই আমাকে নিবৃত্ত করতে। কিন্তু ওরা প্রাণ নাশের হুমকি দিয়ে ওদের মুখ বন্ধ করে বসিয়ে রেখেছিল। তবু প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আমার লোকেদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলে উঠলো, 'রবীনদা এখানে আসবেন না, পালিয়ে যান, এরা আপনাকে মেরে ফেলবে!” ওর কথাগুলো তখনও শেষ হয়নি হঠাৎ দেখি চারিদিক থেকে হৈ হৈ শব্দ করে লাঠি, টাঙ্গি, বগি, রামদা নিয়ে বহু লোক আমার দিকে ছুটে আসছে--কে কোথায় লুকিয়ে ছিল কে জানে !!
। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমটায় আমি একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না যে আমার অপরাধটা কি—ওরা আমাকে একেবারে প্রাণে মেরে ফেলতে চাইছে কেন ! কিন্তু এতো কথা ভাবার সময়ই বা তখন কোথায় !! আমি রানিং-এ সাইকেলটার ব্রেক কষে দাঁড় করিয়ে সাইকেলটাকে সবে ফেলে দিয়েছি_ তা করতে করতেই চারিপাশের উন্মত্ত জনতা তাদের উদ্যত ধারালো অস্ত্র আর লাঠি নিয়ে ১০ হাতের মধ্যে এসে গেল !! ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুই না ভেবে শুধু জোড়হাত করে চোখ বুজে “জয় মা” এই শব্দটা উচ্চারণ করার সময় পেয়েছিলাম ! তারপর ওখানে কি ঘটেছিল সেসব আর আমি কিছুই জানি না। কিন্তু পরে শুনেছিলাম, আমি যে স্থানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানেই তাদের লাঠি-টাঙ্গির ঘা পড়েছিল। কিন্তু যার(গুরু মহারাজ) উপরে আঘাতটা পড়লো তাকে কিন্তু আর ওখানে দেখা যায়নি! ফলে ওদের একের লাঠির আঘাত অপরের ঘাড়ে পড়ে যায় এবং ওরা নিজেদের মধ্যেই মারামারি শুরু করে দেয়। এরকম খানিকক্ষণ চলার পর ওদের সম্বিৎ ফেরে, তাই তো আমরা যাকে মারতে এসেছিসেই মানুষটা গেল কোথায় ! তখন ওদেরই মধ্যেইযারা আমাকে একটু-আধটু চিনতো, সেই রকম দু-একজন বলেছিল ‘রবীনদা সাধারণ মানুষ নয়, ওর উপর আক্রমণ করাটা আমাদের ঠিক হয়নি, এতে আমাদের চরম ক্ষতি হতে পারে !’ গ্রামের কিছু সম্মানীয় মানুষও সেই সময় ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত যুবকদের খুব বকাবকি করেন এবং ইলেকট্রিফিকেশন গ্রামের কত উপকার করবে, তার সম্বন্ধে ধারণা দেন এবং পরের দিন রবীনদার কাছে গিয়ে যাতে আবার কাজটা চালু হয় তার জন্য ক্ষমা চেয়ে অনুরোধ জানানোর কথা বলে তাঁরা চলে যান।
এর ফলে আমাদের লোকগুলো – যারা ওখানে আটকানো ছিল, তাদেরকে ওরা যত্ন করে খাইয়ে-দাইয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল।
এদিকে কিছুক্ষণ বাদে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আমার সম্বিৎ ফিরে এলো ! তখন চোখ খুলে দেখি কি__ আমি ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিমি দূরে চক্ষণজাদী ও জামদো গ্রামের মাঝে এক শ্মশানে দাঁড়িয়ে আছি। এটা দেখে আমি প্রথমটায় একটু হতচকিত হোলেও পরে তা সামলে নিয়ে চক্ষণজাদীতে আমার ভক্ত-সন্তান টগরদের বাড়ী গেলাম। আমার মাথায় চিন্তা ছিল যে, আমার লোকগুলো ওখানে আটকা পড়ে আছে, আমাকে না পেয়ে যদি ওদেরকে মারধোর করে । আমাকে মারধর করতে পারে শুনে টগরও দু-চারজনকে নিয়ে শম্ভুপুর যাচ্ছিলো, মাঝপথ থেকেই খবর পেয়ে ফিরে এলো। ঐ বাড়ীর মা তো আমাকে পেয়ে আর কোথাও বেরোতে দিল না। এক গ্লাস জল খেতে দিল, তারপর নারকেল দিয়ে মুড়ি হাতে ধরিয়ে বলল, 'তুই সুস্থ হয়ে বসে বসে খা ! টগর যখন গেছে, তখন একটা ভালো খবর নিয়ে তবে ফিরবে।' টগর ফিরে এসে ওখানকার সমস্ত ঘটনা জানালো এবং বললো যে, আমাদের দলের সমস্ত শ্রমিকেরা একদম সুস্থ আছে এবং তারা ক্যাম্পে ফিরে গেছে।
এই হোলো শম্ভুপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ! যেটার ব্যাখ্যা আমি তাৎক্ষণিভাবে পাইনি । ঘটনাস্থল থেকে রক্ষা পাবার যেহেতু আমার কোনোরূপ সংকল্প ছিল না অর্থাৎ আমার কোনো চাওয়া কাজ করেনি, তবুও এইরকম একটা ঘটনা কিভাবে ঘটে গেল_সেইটা আমাকে বাড়িয়েছিল !