জিজ্ঞাসু :– অদ্ভুত ব্যাপার, সত্যিই কি এই রকমও হয় !! আপনি আরও একটা এই ধরণের কোনো ঘটনার কথা বলছিলেন__ সেইটা যদি বলেন !
গুরুমহারাজ :— দ্যাখো, এই রকম ঘটনা আমার জীবনে অনেকবার ঘটেছে কিন্তু আমি তোমাদের কাছে সেগুলোই উল্লেখ করতে চাইছি, যেগুলোর eye witness এখনো রয়েছে। যেমন শম্ভুপুরের ঘটনায় যারা লাঠিসোটা হাতে ওখানে উপস্থিত ছিল, ওদের অনেকেই এখন আমার দীক্ষিত। দেবু সেনের পরিবার বা অন্য দু-চারটে ভক্ত-পরিবার এখন আমাকে শম্ভুপুরে নিয়ে যায় । ঐ গ্রামে আশ্রমের অন্যান্য মহারাজরাও যায় বিভিন্ন কাজে, ওই গ্রামের সেইসব আক্রমণকারীরাই মহারাজদেরকে সাহায্যও করে।
যাইহোক, আর যে ঘটনাটা তোমাদেরকে বলতে যাচ্ছি—এই ঘটনারও eye witness-রা এখনো শরীরে রয়েছে। তাছাড়াও এই ঘটনাটির সঙ্গে আমার চাকরি ছাড়ার একটা যোগাযোগ রয়েছে। এসব কথা থাকএখন ঘটনাটি বলছি শোনো। আমাদের তখন রুরাল ইলেকট্রিফিকেশনের কাজ চলছিল রায়নার কাছাকাছি এক জায়গায় । সেখানেই তখন আমাদের Camp হয়েছিলবেশ কয়েকজন ছেলেদেরকে নিয়ে আমি তখন ওখানেই থাকতাম। তখন Emergency Period(1975/76 সাল) চলছিল, ওখানকার চাষীদের বিদ্যুতের অভাবে বোরো ধান মারা যাচ্ছিলো, ফলে শত শত চাষীরা সরকারী দপ্তরে ধরণা-ঘেরাও এইসব করে এমন Order বের করেছিল যে, সাতদিনের মধ্যে ঐ বিস্তীর্ণ এলাকায় Electrification-এর কাজ তুলে দিতে হবে, নাহলে D. E, A. E—সবার চাকরি নিয়ে টানাটানি !
আমাদের team-কে তখন ওখানে পাঠানো হয়েছিল ঐ কাজটি তুলে দেবার জন্য । আমাদের হাতে সময় ছিল মাত্র সাত দিন। আমার দলের ছেলেরা আমাকে খুবই ভালোবাসতো, আমি জানতাম যে, ওদেরকে অনুরোধ করলে রাতদিন খেটে ওরা কাজটা পাঁচ দিনেই তুলে দেবে ! কারণ দ্যাখো__এই কাজগুলিতো শ্রমিকদের হাতে, কারণ ইচ্ছা করলেই একটু বেশি সময় শারীরিক শ্রম দিলে এই ধরণের কাজ তুলে দেওয়া যায়। আমি দেখেছি_ মানুষের কাজের প্রতি নিষ্ঠা বা শ্রদ্ধার অভাব থাকে বলেই তারা কাজে ফাঁকি দেয়, অনেকে তো কাজ করতেই চায় না !
যাইহোক, পুরোদমে আমাদের কাজ চলছিল আর A. E অর্থাৎ এ্যাসিট্যান্ট ইঞ্জিনীয়ার সদা- সর্বদা কাজের তদারকি করছিলেন, কারণ ওঁরই উপর এই কাজটির মূল দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। ওনার উপর ঊর্ধ্বতন অফিসারদের এমন চাপ ছিল যে, উনি অনেক সময় রাত্রিতে ক্যাম্পেই থেকে যেতেন। সেইসময় ইমার্জেন্সী পিরিয়ড চলছিল তো অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা_মন্ত্রীসভার হাতে নয়। তখন একটু বেচাল হোলেই অফিসারদের চাকরি চলে যেতো।
এসব কথা থাক্আসল কথায় আসি ! আমাদের কাজ খুব দ্রুত এগিয়ে চলছিল,তাই নির্দিষ্ট সময়ে কাজটা শেষ করার ব্যাপারে আমার কোনো tension-ই ছিল না। আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম যে, পাঁচ থেকে ছয় দিনের মধ্যেই পুরো কাজটাই উঠে যাবে। সেদিন একটা গাছতলায় বসে বসে ভাবছিলাম—কৃষ্ণদেবপুরে গর্ভধারিণী জননীর কাছে অনেকদিন যাইনি, আর সেই মাসের টাকাটাও মাকে দেওয়া হয়নি ! তাহলে এই সুযোগে যাই একবার কৃষ্ণদেবপুর থেকে ঘুরে আসি ! আবার মনে হোতে লাগলো চক্ষণজাদীর টগরের বাবা সাত্তার সাহেবকে কথা দেওয়া আছে তাঁর মৃত্যুর সময় যেন আমি উপস্থিত থাকি উনি তো অসুস্থ, বর্ধমানে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন_ ফলে সেখানে যাওয়াটাও খুব প্রয়োজন! এইসব সাত-পাঁচ ভাবনা আসছিল। তাই উঠে গিয়ে ইঞ্জিনীয়ার সাহেবকে বললাম যে, ‘কাল সকালে আমাকে একবার বাড়ী যেতে হবে, তবে তাড়াতাড়িই ফিরবো। আর আমি আমার ছেলেদের বলে যাচ্ছি- আপনার কাজের কোনো অসুবিধা হবে না।’ ইঞ্জিনীয়ার, ওভারসীয়র ইত্যাদি যারা ছিল- —তারা একথা শুনেই একেবারে লাফিয়ে উঠলো, বললো ‘রবীনবাবু আপনি না থাকলে কোনো কাজই হবে না, আর কাজ ঠিক সময়ে না হোলে আমাদের চাকরি চলে যাবে! আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে নাএখানে যতদিন না কাজ শেষ হয় আপনি শুধু বসে থাকুন, তাহলেই চলবে! আপনি উপস্থিত না থাকলে লোকেরা এতোটা দায়িত্ব সহকারে কাজ করবে না। কাজ শেষ হয়ে গেলে আপনি একদিন কেন দশদিনের জন্য বাড়ী যানআমরা কিছু বলবো না।’
আমি যতো ওনাদের বোঝাবার চেষ্টা করি, তাঁরা ততোই নাছোড়বান্দা ভাব দেখায় !কোনোমতেই ওনারা আমার সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টাই করলেন না। এই ঘটনায় আমার মনটা ভীষণভাবে দুঃখিত হয়ে গেল। মনে হোলো_'আরে দূর-দূর ! এরই নাম চাকরি –এতো পরের গোলামি খাটা ! আমি তো চির মুক্ত, চির স্বাধীন ! শুধুমাত্র চাকরি করতে এসেই এই বন্ধন দশায় আটকে পড়লাম ! চাকুরি জীবনের উপর ঘৃণা এসে গেল, মনে হোলো এই কাজটা শেষ হয়ে গেলেই মায়ের অনুমতি নিয়ে চাকরি ছেড়ে দেব। এইসব ভাবতে ভাবতে চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে ওদের কাছ থেকে একটু দূরে একটা আমগাছের শীতল ছায়ায় চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ বসার পরেই দেখলাম সামনে গুরুদেব স্বামী বাউলানন্দজী উপস্থিত হোলেন ! তিনি আমাকে উপরে উঠার জন্য ইঙ্গিত করতেই—আমি আর উনি উপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। এরপর কিছুক্ষণের জন্য আর আমার চেতনা ক্রিয়াশীল ছিল না ! পরের ঘটনাপ্রবাহ যে কি ঘটেছে তা আমি মোটেই জানি না।
একমাত্র তৃষাণ ঘটনাটা ঘটার দু-চার দিনের মধ্যেই পুরো ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল কিন্তু আমাকে বলেনি ! ও পরীক্ষা করতে চেয়েছিল—আমি এটা ইচ্ছা করে ঘটিয়েছি, না– মা জগদম্বার ইচ্ছায় ঘটনাপ্রবাহ ঘটে গেছে।
ঘটনাটা যখন ঘটছিল তখন ঘড়িতে সকাল ১০টা ১০ মিঃ। তৃষাণ তখন কালনা-বর্ধমান রুটের উপর সাতগাছিয়া স্টপেজে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ ও দেখেছিল আমি একটা বাস থেকে নামলাম এবং ওর সাথে কিছু কথাবার্তা বলার পর একটা দোকানে দু’জনে জলখাবার খেলাম। এরপর আমি ওকে টগরের বাবা বর্ধমানের যে নার্সিংহোমে ভর্তি আছে তা জানালাম আর ওকে কিছু টাকা দিয়ে এবং টগরের বাবা মারা গেলে কি করতে হবে তার নির্দেশ দিয়ে বর্ধমানে পাঠিয়ে দিলাম। এছাড়া শনিবারে ওর সঙ্গে যে আমার দেখা হোচ্ছে তা জানিয়ে—অন্য একটা বাসে চেপে ‘বিশেষ কাজ আছে’_ বলে চলে গেলাম । ……. (ক্রমশঃ)