জিজ্ঞাসু :– আপনি তো আমাদের গুরুদেব, তাহলে আপনাকে কি বলে সম্বোধন করা উচিত?
গুরুমহারাজ :-- জানো__ আমাকে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ভাব আরোপ করে সম্বোধন করে। অনেকে আমাকে দাদা বলে, কেউ মামা বলে, কেউ আবার দাদুও বলে ! অনেকে আবার আমাকে বাবা বলে ডাকে, কেউ বলে বাবাঠাকুর ! বনগ্রামের ভূমিজরা আমাকে বলে রবীনঠাকুর। তৃষাণের বাবা বলে ‘মা পরমানন্দ' !
তবে ট্রেনে বাসে যখন কেউ আমাকে কথা বলার সময় ‘দাদা’ সম্বোধন করে তখন মনে হয়__ ‘কি শিক্ষিত এরা’ ! দেখছে যে একজন গেরুয়াপরা সন্ন্যাসী, অন্তত ‘মহারাজ’ বা ‘স্বামীজী’ বলতে পারে, কিন্তু সে সংস্কারও নেই আর সে শিক্ষাও নেই। তবে এই সমস্ত সম্বোধনে আমার কোনো অসুবিধা হয় না কারণ আমি তো পৃথিবীগ্রহের মানুষের মানসিকতা বা তাদের চেতনার level জানি, তাই মানিয়ে নিই। যে যাই বলে সম্বোধন করুক না কেন, আমি তাদের সাথে তাদের ভাব অনুযায়ীই commuication করি ! আবার অনেক সময় দেখি ‘ভজা’ লোক অর্থাৎ অন্তঃসারশূন্যরা শুধুই ভজভজ্ করে বকছে—তাদেরকে এড়িয়ে যাই। আমার কিছু মায়েরা আছেন যাঁরা আমার নাম ধরে ডাকেন, তাদের আবার কেউ বা আমাকে ‘গোপাল’ বলেন, কেউ আমাকে সন্তানবৎ ভাব আরোপ করে ‘বাবা’ বলে ডাকেন।
ইউরোপের দেশগুলিতে যখন আমি গেলাম_ তখন ওখানকার ভক্তরাই শুধু নয়_ছেলে বুড়ো সবাই “হাই পরমান্দ্! হাই পরমানন্দ্ ” ইত্যাদি বলে সম্বোধন করতো। ইংরাজীতে ‘you’ শব্দটি ‘তুই’, ‘তুমি’, ‘আপনি’–এই তিনটি শব্দকেই বোঝায়—তাই সকলেই you সম্বোধন করতে পারে। এবার ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরাও ঐসব দেশে যখন ‘Hi Paramananda’ বলছিল তখন প্রথম প্রথম একটু যেন কেমন কেমন লাগছিল। পরে অবশ্য তাদের সঙ্গে আমার খুবই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।
এখানে অনেক মেয়ে আছে যারা আমাকে তাদেরই 'বিশেষ' একজন মনে করে। আমার কাছে এলে মাথায় কাপড় দেয়, আমাকে উদ্দেশ্য করে সিঁদুর পরে, আবার আমার সামনে এসে একটা সলজ্জ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে ! এটাও নাকি একপ্রকার সাধন পদ্ধতি__এটা আবার তাদের কি সাধনা জানিনা বাবা !
দ্যাখো, কপটতা আমি পছন্দ করিনা। সহজ-সরল ভাবই তো ভালো। জোর করে কিছু আরোপ করে লাভ কি ? আমার গুরুদেব বলতেন, ‘বনো মৎ–বনে সে পিটাই হোগা'। এই কথাটা সাধুসমাজে চালু একটা গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। গল্পটা বলছি শোনো !
একবার এক গুরুদেবের কাছে একজন অসৎ ব্যক্তি এসে দীক্ষার জন্য আবেদন করলো। গুরুদেব লোকটির মানসিকতা সবই বুঝলেন এবং কিছুদিন তাঁর সঙ্গ করার জন্য বললেন। কিছুদিন গুরুসঙ্গ করার পর লোকটির মনের সামান্য পরিবর্তন হোলো এবং সে গুরুদেবের কাছে সন্ন্যাস নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। গুরুদেব লোকটির পরিবর্তন লক্ষ্য করে কোনো শুভদিন দেখে তাকে সন্ন্যাস দিয়ে দিলেন এবং সাধুদের কর্তব্য সম্পর্কীয় কিছু শিক্ষাও দিলেন। তার মধ্যে একটি শিক্ষা ছিল—‘বনো মৎ, বননে সে পিটাই হোগা!'
সন্ন্যাস নেবার পর গুরুদেবের সঙ্গে শিষ্য চলল পরিব্রাজনে । পথশ্রমে ক্লান্ত শিষ্য আর গুরুদেবের সঙ্গে হাঁটতে পারছে না। একেতো ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, তাছাড়া তখন সন্ধ্যা সমাগত। কাতর হয়ে শিষ্য বলে উঠলো, ‘গুরুদেব আর তো হাঁটতে পারছি না এবার একটু বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিন’। গুরুদেব তাকে আশ্বস্ত করে বললেন_ ‘এই জঙ্গলেই একটি বাড়ি আছে, সেখানেই রাত্রিযাপন হবে, তবে সে যেন গুরুর দেওয়া শিক্ষাগুলি সঠিকভাবে মনে রাখে।’
সত্যিই সেই জঙ্গলের মধ্যে একটি অট্টালিকা ছিল। প্রকৃতপক্ষে ওটি ছিল স্থানীয় রাজার বাড়ি। যখন রাজা মৃগয়ার জন্য জঙ্গলে থাকতেন, তখন ঐ বাড়িতে রাত্রিযাপন করতেন। যাইহোক, সেদিন গুরুদেব শিষ্যকে নিয়ে যখন ওখানে পৌঁছালেন— তখন দেখা গেল বাড়ির দরজাগুলি খোলা রয়েছে, খাবার ঘরে থরে থরে খাবার সাজানো, বিশ্রাম কক্ষে পালঙ্কে সুসজ্জিত শয্যা পাতাই রয়েছে। গুরুদেব বাড়িতে ঢুকেই দালানের এক পাশে ধুনি জ্বালিয়ে নিত্যনৈমিত্তিক সান্ধ্যকৃত্য সমাপন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন কিন্তু শিষ্য সারাদিনের ক্ষুধা-তৃষ্ণার ক্লেশ সম্বরণ করতে না পেরে খাবার ঘরে ঢুকে কিছু খাদ্য নিজেই নিয়ে খেয়ে নিল ! তারপর পথশ্রমের ক্লান্তি নিবারণের জন্য পাশের ঘরে গিয়ে পালঙ্কে আরামে শুয়ে পড়লো।
এদিকে হয়েছে কি—রাজা তো সেইদিনই সেখানে শিকারে এসেছেন। সন্ধ্যার পর সসৈন্যে ওখানে ফেরার পর দেখলেন একজন সাধু ভিতরের বারান্দার এক কোণে বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন—উনি মনে মনে তাঁকে প্রণাম করে ভিতরে ঢুকে দেখলেন, অন্য একজন তাঁর খাবার উচ্ছিষ্ট করে তাঁরই শয্যায় শায়িত। ক্রোধে অধীর হয়ে রাজা চিৎকার করে শিষ্যটির ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তুমি ?” শিষ্যটির কাঁচা ঘুম ভেঙে যেতেই সে বলে ফেললো, “আমি ত্যাগী, সাধু-মহাত্মা, তোমার ঘর আজ আমাদের পদস্পর্শে ধন্য হোলো।” একথা শুনেই রাজা বললেন, “আমি এদেশের রাজা, আমি জানি কে প্রকৃত সাধু বা মহাত্মা আর কে তা নয় ।” এই বলে তিনি তাঁর দেহরক্ষীদের বললেন, ' বাইরে ধ্যানে বসে থাকা ঐ সাধুবাবার ধ্যান ভঙ্গ হোলে তাঁকে সসম্মানে এই ঘরের ভিতরে নিয়ে আসবে, আর এই পামরটাকে মারতে মারতে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়ে এসো।' রক্ষীরা রাজার আদেশ অনুযায়ীই কাজ করলো। পরের দিন সকালে গুরুদেব বাইরে বেরিয়ে দেখলেন তার শিষ্য রক্ষীদের হাতে মার খেয়ে পথের উপর একধারে মৃতবৎ পড়ে রয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে তোমার ?” শিষ্য কাঁদতে কাঁদতে তার দুর্গতির কথা বললো। গুরুদেব বললেন, সন্ধ্যার সময় সাধুর কর্তব্য সন্ধ্যা-আহ্নিক করা, তা না করে তুমি ভোগীদের মতো আহার- নিদ্রায় মত্ত হোলে ! আর রাজা যখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন তখন তুমি নিজেকে কি বলে পরিচয় দিয়েছো— 'ত্যাগী, সাধু-মহাত্মা' এইসব বলে _যা তুমি নও! তোমাকে তো আগেই আমি বলেছিলাম, 'তুমি যা--- তুমি তাই থাকার চেষ্টা কোরো, কোনকিছু সাজতে যেয়ো না ! আর তা করতে গেলেই পিটাই হবে—আর হোলোও তো তা-ই।”(ক্রমশঃ)