জিজ্ঞাসু : আপনার চাকুরী জীবনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আধ্যাত্মিক ঘটনা ঘটেছিল কি ?
উঃ—হ্যাঁ, ঘটেছিল। আমি তখন বীরভূমের ওদিকে ইলেকট্রিকের কাজ করছি, ক্যাম্প-লাইফ। কয়েকজন ছেলে নিয়ে মাঠে মাঠে Rural Electrification-এ কাজ করছি। ঐ সময় ওখানে পুরন্দরপুর বলে একটা গ্রামের পাশে একটা জীর্ণ শিবমন্দিরে আমি রোজ ধ্যান করতে যেতাম। মন্দিরটা গ্রাম থেকে একটু দূরে। পুরোহিতমশায় এক ভট্টচার্য, মন্দিরটা পরিষ্কারও করে না—শিবলিঙ্গরও যত্ন নেয় না। বোধহয় মন্দিরের নামে দেবোত্তর সম্পত্তি যা ছিল, তা বেচে খেয়ে নিয়েছে। তাই এমন দায়সারা করে নিত্যপুজোটা করে। আর জায়গাটা একটু জঙ্গলমতো, সাপ-খোপ ও ভূত-প্রেতের আখড়া বলে সন্ধ্যার শীতলটা বেলা থাকতে-থাকতেই দিয়ে পালাতো। ফলে সন্ধ্যা থেকে আমি নির্ঝঞ্ঝাটে ওখানে রাতটা কাটাতে পারতাম। শিবমন্দির হচ্ছে সাধু-সন্তদের নিরাপদ জায়গা, আর সাধু-সন্ত কেন, সবারই। কারণ শিবই একমাত্র দেবতা—যিনি আশুতোষ অর্থাৎ অল্পে সন্তুষ্ট, ভূতনাথ অর্থাৎ ভূত-প্রেতেরও সেখানে অবাধ গতি, পশুপতি অর্থাৎ পশুরাও সেখানে যেতে পারে, এইভাবে তিনি লোকনাথ আবার দেবাদিদেব। তাই যে কোন ব্যক্তি যে কোন সময় শিবমন্দিরে যেতে পারে, প্রয়োজনে শিবকে ছুঁতে পারে। বহু সাধুকে দেখেছি রাত্রে কোন শিবমন্দিরে শিবলিঙ্গকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে। তবে সাবধান, কারণ সাপেরাও শিবলিঙ্গ জড়িয়ে থাকতে ভালবাসে। এর কারণ শিবলিঙ্গ খুব ঠাণ্ডা হয়, আর শিবমন্দির সাধারণত জানালাহীন ছোট দরজা-বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এরফলে ভিতরটায় আলো-আঁধারি একটা ভাব থাকে। আর এগুলোই সাপের বসবাসের প্রকৃষ্ট জায়গা ।
আমার ক্ষেত্রে হল কি, ঐ যে মন্দিরটা নোংরা হয়েছিল, আমি প্রথম দিনেই ঝাঁট-পাট দিয়ে বেশ খানিকটা পরিষ্কার করেছিলাম। পুজুরী তো পরের দিন পুজো করতে এসে সেটা দেখেছে। আর তারপর দিন আরও খানিকটা পরিষ্কার করেছি—মন্দিরের ভিতরটা চামচিকের গুয়ে ভর্তি ছিল, সেগুলো ধুয়ে-মুছে সাফ করেছি। এসব দেখে দু’চার দিন পর সে ঐ পাড়ায় খবর নিয়ে জানতে পেরেছে যে, রাত্রে একটা ছেলে এসে থাকে। এটা শুনে একদিন পাড়ার দু’চার জন ছেলে জুটিয়ে এনে আমাকে মন্দির থেকে বের করে দেবার মতলব করলো। আমিও নন্দীভাব ধারণ করে বললাম, ‘ব্যাটাকে ঘাড় ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেবো, বেরো, নইলে তোর চরম অনর্থ ঘটাবো !’ ও কি বুঝল কে জানে—পালালো ৷
পরদিন তো আর এক ব্যাপার । রাত্রে ওর দর্শন হয়েছে শিব ওর উপর চরম অসন্তুষ্ট। ফলে সেই ভট্ট্চায্ গিন্নি সহ আরও অনেককে নিয়ে এসে ফল-ফুল দিয়ে তোড়জোড় করে শিবের পুজো করেছে আর সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে আছে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য। আমি যেতেই তো সবাই প্রণাম-ট্রণাম করে একেবারে অস্থির। ভট্টচা মশাই বলল, ‘বাবা, তোমাকে কাল আমার বাড়ী গিয়ে খেতেই হবে নাহলে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। যাইহোক কি আর করা যায় পরের দিন তার বাড়ী গিয়ে দেখলাম—চরম দুরবস্থা ভট্ট্চাযের। বললাম, ‘দেখ, তুমি দেবাদিদেব মহাদেবের পূজারী। আর তোমার এই অবস্থা ! তাহলে লোকে মহাদেবকে কি মানবে ? তোমাকে দেখেই তো ঠাকুরের প্রতি মানুষের ভক্তি ছুটবে। তোমার এই দুর্দশা কেন বলতো, তুমি ভক্তিভরে পূজা কর না—পূজায় চরম অনীহা, তাই তোমার উপর দেবতা রুষ্ট। লক্ষ্মী মহাদেবের কন্যা, কি করে তিনি তোমার উপরে সদয় হবেন ! জানো তো কলির ব্রাহ্মণের উপরে সীতার অভিশাপ আছে। এবার থেকে ভক্তিভরে শিবপূজা করো, মন্দিরটা পরিষ্কার রেখো, শিবলিঙ্গকে যত্ন করো। মানুষের মনে শিব সম্বন্ধে শ্রদ্ধার ভাব সৃষ্টি করো, দেখবে তোমার সমস্ত অভাব দূর হয়ে যাবে।’
ও বলল – -“কিন্তু সন্ধ্যায় ওখানে নানারকম ভৌতিক ক্রিয়া হয়, তুমি থাকো কি করে ?’আমি বললাম, ‘আমি আরও বড় ভূত, আমাকে দেখে ছোট ভূতেরা এখন পালিয়ে গেছে—তোমার আর কোন অসুবিধা নেই। এবার থেকে সন্ধ্যার সময়ই মন্দিরে যাবে, শীতল দেবে, আরতি করবে, কোন অসুবিধা হবে না।’
ঘটনাটা কিছুটা সত্যিই ছিল, কিছু অপদেবতার বাস ছিল ওখানে, আর যেটা ছিল সেটা হচ্ছে দুষ্কৃতীদের আড্ডা। তারাও তো জনহীন পরিত্যক্ত জায়গা পছন্দ করে। ফলে হয়তো কোনসময় না কেউ রাত্রে থাকতে চেয়েছে, ওরাই উৎপাত করেছে। এটাই ভৌতিক ক্রিয়া বলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। যাইহোক এরপর থেকে ওখানে আমি থাকতে পেলাম কিন্তু নির্বিঘ্নে থাকতে পারলাম না, কারণ গ্রামের সাধারণ লোক আমাকে অসাধারণ কিছু ভেবে মাঝে মাঝে উৎপাত করতো। যাইহোক আমার যা কাজ তার খুব একটা ব্যাঘাত হত না। ওখানকার শিবকে দেখে কেবল আমার মনে হত—শিবের মতো ধ্যানমগ্ন হতে হবে। বীরভূমের যেখানে আমাদের ক্যাম্প ছিল, তার কাছেই এক শ্মশানে একদিন সংকল্প করলাম যে, আজ ধ্যানের গভীরে ঢুকে দেখবো কি আছে তাতে, যদি আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুসমূহ ছিঁড়ে যায় তো যাক্।
অন্তর্মুখী হতেই আমার অন্তর চেতনা একমুখী হয়ে আমাকে হু হু করে কোথায় যেন ভাসিয়ে নিয়ে চলে যেতে লাগল ! তারপর পরিদৃশ্যমান হল, সমুদ্রের মতো এক বিশাল জ্যোতিঃসমুদ্র—একেবারে থকথক্ করছে। একদম শান্ত নিস্তরঙ্গ কিন্তু থকথক করছে। তারপর দেখলাম সেখানে আমি আছি আর ষোলজন চতুর্ভুজ বিষ্ণু আমার চতুর্দিকে আমাকে বেষ্টন করে রয়েছেন। আরও কিছু সময় পরে দেখলাম ধীরে ধীরে তাঁরা আমার শরীরে মিশে গেল। এরপর দেখলাম, সেই জ্যোতিঃসমুদ্র থেকে একে একে তরঙ্গ উঠে আসছে, ছোট তরঙ্গ, বড় তরঙ্গ আর অসংখ্য বুদ্বুদ। সেই বড় বড় তরঙ্গগুলি বিশাল হতে হতে এক-একটা রূপ পরিগ্রহ করছে—একটা হ’ল কৃষ্ণ, একটা রাম, একটা যীশু, একটা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু–এইভাবে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ। এইসব দর্শন হতে থাকল আর সত্যিই আমার মস্তিষ্ককোষগুলোর উপর এত চাপ পড়েছিল যে, এরপর থেকে ক্যাম্পের লোকেরা আমাকে খ্যাপা-পাগল মনে করতে লাগল ৷ দক্ষিণ ভারতের দেবেন্দ্রনাথ তখন ওখানে গিয়েছিল। ও সমস্ত শাস্ত্ৰ -পুরাণ ঘাঁটতো এবং বিভিন্ন সাধুসঙ্গ করেও বিভিন্ন আধ্যাত্মিক লক্ষণের বিচার করতে পারতো। আমি ওকে দর্শনের কথাটা বললাম, ও বলল ‘কোন শাস্ত্রে তো এই ধরণের দর্শনের কথা পাইনি তবে খোঁজ নিয়ে শীঘ্র জানাবো।’ এই বলে দেবেন্দ্রনাথ চলে গেল এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন মহাত্মাকে ঐ দর্শনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিল। তবে কেউ বিশেষ কিছু বলতে পারেনি। শেষে উত্তরকাশীর ধর্মবতী মাকে এই দর্শনের কথা বলতেই, উনি বলেছিলেন, ‘যাঁর এরূপ দর্শন হয়েছে তিনি সাক্ষাৎ পুরুষোত্তম, পঞ্চভূতের শরীর নিয়েছেন বলে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখেছেন। তাঁকে ষোলজন বিষ্ণু চারিদিকে বেষ্টন করে রয়েছেন অর্থাৎ তিনি ষোলকলায় প্রকাশিত। আর চতুর্হস্ত হওয়ায়—৪×১৬=৬৪ কলা বা সিদ্ধিই তাঁর করায়ত্ত । এইরূপ মহামানবের দর্শন করাও বহু ভাগ্যের কথা। তোমার সাথে দেখা হলে এই মায়ের কথা বোলো।’ পরে আমি যখন উত্তরকাশীতে গুরুদেব রামানন্দ অবধূতজীর সাথে দেখা করলাম, তখনই ওনার সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। ওনার পাঞ্জাবী শরীর ছিল। উচ্চকোটী সাধিকা ছিলেন। ওনার পূর্ণ জ্ঞান হয়েছিল। আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। গুরুদেবের আশ্রমে গেলে গুরুদেবই পাঠাতেন ওনার কাছে। উনি আমাকে পেয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। তার পরে-পরেও কয়েকবার ওনার সাথে যোগাযোগ হয়। ওখানে গেলে উনি নিজে রান্না করে খাওয়াতেন। আমিও একবার রান্না করে ওনাকে খাইয়েছিলাম।