জিজ্ঞাসু : গুরুমহারাজ। এতক্ষণ অনেক এমন প্রসঙ্গ হল, যা শুনে মনে হচ্ছে যেন আমাদের চেতনার জগতে নতুন দিগন্ত খুলে গেল। কিন্তু আমরা আপনার বাল্যজীবনের ঘটনা থেকে একটু দূরে সরে এসেছি, আপনি হিমালয় ভ্রমণের কথা – সেই কিমিয়াবিদ্যা জানা সাধুটার কথা বলছিলেন—তারপর আপনি কোথায় গেলেন বা উল্লেখযোগ্য আর দু-একটা ঘটনা যদি অনুগ্রহ করে বলেন তো কৃতার্থ হই ।
গুরুমহারাজ : দ্যাখো পৃথিবীগ্রহের বিভিন্ন স্থানে ঘোরার সময় আমার এইটা জানা হয়েছে যে, সবসময় মা যেন আমার হাত ধরে ধরে নিয়ে যেতেন। অর্থাৎ ব্যাপারটা কেমন ঘটে জানো যে কোন পরিস্থিতিতে যা মনে হচ্ছে খুবই কঠিন বা দুর্লঙ্ঘ্য ঠিক সেইসময়ই দেখা যায় এমন কেউ এসে সমস্যার সমাধান করে দিলেন কিংবা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। শরণাগত থাকার এটা একটা ফল। যা তোমরাও তোমাদের জীবনে পেতে পারো যদি ঠিক ঠিক শরণাগত হও। সহজ-সরল-নিষ্কপট হও। তবে অনেকে উদাহরণ দেয় শিশুর মতো সরল হতে হবে। আমি বলি না—শিশুর মধ্যেও অসহজতা থাকে। কোন জিনিস হাতে থাকলে অন্যকে দিতে চায় না, ভাল খাদ্য বা খেলার জিনিস ভাগ করে নিতে চায় না, তাই শিশুর মতো সরল হলেও ঈশ্বরলাভ তার হবে না বা ঠিক ঠিক শরণাগতি হল না। গর্ভস্থ শিশুর ন্যায় হতে হবে—যেখানে পরিপূর্ণ Surrender। স্বাধীন কোন ইচ্ছাই নেই—নেই কোন কর্ম-প্রবণতা, এমনকি শরীর রক্ষার জন্যও নিজস্ব কোন তাগিদ নেই। তাইতো জগন্মাতা সন্তানের সম্পূর্ণ ভার নেন। তার বুদ্ধি-বিকাশ, খাদ্যগ্রহণ, শ্বাস-প্রশ্বাস, রেচন— সমস্তই সেই মহাপ্রকৃতির নিয়ন্ত্রণে হয়ে থাকে। এটাই ঠিক ঠিক শরণাগতির উদাহরণ। তবে তোমাদের আমি আগেও বলেছি যে, আধ্যাত্মিক জগতের কোন কিছুই জাগতিক অন্য কিছু দিয়ে উদাহরণ দেওয়া যায় না, তবু যাদের একেবারেই ধারণা নেই, তাদের মোটামুটি ধারণা দেবার জন্যই উদাহরণ টানতে হয় আর সেই উদাহরণটি যতটা সম্ভব appropriate করার চেষ্টা করতে হয়।
যাইহোক, আগের কথায় ফিরে আসি। আমি যখন হিমালয়ের গভীরে প্রবেশ করলাম, তখনই চিন্তা হল—তাইতো এই বিশাল হিমালয় পর্বতমালা, যার কয়েক হাজার চূড়া, কোথায় কি আছে, কিভাবে সে সব ঘোরা যাবে । পৃথিবীগ্রহের শরীর, ফলে তার যা ধর্ম সেটাকে তো লঙ্ঘন করা যাবে না— হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে মা তাও করেছে, কিন্তু সেগুলো আমার ইচ্ছায় হয়নি। যাইহোক আমার যখন ঐ ধরণের চিন্তা মাথায় আসছিল, তখনই দু’জন নাগা সন্ন্যাসীর যেন হঠাৎ আবির্ভাব হল। এঁদের একজন দীর্ঘদেহী বিরাট চেহারার, অন্যজন একটু খর্বকায়। তাঁরা আমাকে বললেন—তাঁদের উপর নাকি আদেশ আছে আমাকে হিমালয় ঘোরাবার, ফলে আমার আর কোন চিন্তা রইলো না! হিমালয়ের সমস্ত কিছুই তাঁদের নখদর্পণে। কিছুদিনের মধ্যেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম—তাঁরা নানান যোগবিভূতির অধিকারী এবং সর্ব বিদ্যায় পারদর্শী, বিশেষত চিকিৎসাবিদ্যার চমকপ্রদ নিদর্শন তাঁদের কাছে দেখেছিলাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম যে, তাঁরা শিবস্বরূপ মহাত্মা, বিভিন্ন সাধুদের রক্ষা করাই তাঁদের কাজ। পরবর্তীকালে বনগ্রাম বা অন্য কোথাও আমার শরীরে কিছু হলে গভীর রাত্রে তাঁরা আবির্ভূত হয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিতেন। ন’কাকা, তৃষাণ এদের সামনেও অনেকবার এরকম ঘটনা ঘটেছে।
যাইহোক, তাঁরা অদ্ভুত কৌশলে আমাকে হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতে লাগলেন। কোথাও পাহাড়ের অভ্যন্তরে গুহার ভিতর দিয়ে রাস্তা, কোথাও ঝরনার ভিতর দিয়ে রাস্তা, কোথাও কি শীত ভাঙতো ? তাই হয়তো ওঁরা জন্মলগ্নের পোশাকটাই ঠিক বলে ব্যবহার করতেন। যাইহোক ১৪০০০ ফুট উঁচুতে ঐ ফুলগাছগুলি যেমন সুন্দর তেমনই প্রাণঘাতী। সাধুদের চলতি কথায় আছে যে, শিবক্ষেত্র হিমালয়। তাই শিবজী ছাড়া অন্য কেউ ঐ ফুল তুলতে পারে না। তাই ওই গাছগুলিতে হাত দেওয়া মারাত্মক বিপদ ! ঘটনাটা কি ঘটে জানো— সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাবে বরফের উপর সঞ্চিত জলকণাতে তড়িৎ বিশ্লেষণ ঘটে যায়। ফলে একধরণের electricity তৈরি হয়। এবার গাছগুলোও বরফাচ্ছন্ন থাকে, রোদ্দুরে গলে যায় বরফ। এই সময়ই ঐরকম electricity তৈরি হয়। ওটা যে কোন কারণে ঠিক মতো earth connection হয় না, ফলে একটা high voltage electricity ঐ সারি সারি গাছগুলোয় সবসময় থাকে। কেউ হাত দিলেই মৃত্যু অথবা একটা বড় ধরণের acci- dent। আমি দেখেছি একজন সাধুকে ঐ গাছে হাত দিয়ে যার গোটা হাতটা বেগুন পোড়ার মত পুড়ে গিয়েছিল। তবে কি আশ্চর্য জানো সাধুটি ঐ অবস্থাতেই প্রায় ১ মাস ঘোরার পর তবে হরিদ্বারে ফিরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। তখন অবশ্য গ্যাংগ্রীন হয়ে গিয়েছিল হাতটাতে—শুধু হাড় ছাড়া আর কোন মাংস ছিল না। কি অসাধারণ ধৈর্য এবং সহ্য ক্ষমতা ভাবো একবার। অবশ্য ঐ উচ্চতায় থাকার ফলে অত্যধিক কম তাপমাত্রায় দ্রুত পচন হতে পারেনি। তাহলেও শুধু সংকল্প রক্ষার জন্য অত কষ্ট সহ্য করার মতো মানুষ কজন আছে ?
যাইহোক, আমি এসব দেয়েছিলাম আবার শুনেছিলামও অনেক ঘটনা। তাই আমি নিজেও দিলাম হাত। কিন্তু কি আশ্চর্য! আমার কিছু হয়নি। সাধুরা বলল –হয়তো কোন কারণে ঐ সময় elec tricity neutralise হয়ে গিয়েছিল, তাই আমি রক্ষা পেয়েছিলাম। এছাড়া, ওখানে সোজাসুজি তাকিয়ে চলাও খুব বিপজ্জনক। ‘ত্রাটক বিদ্যা’ বলে এক ধরণের যোগ শিখতে হয় আর তাছাড়া চোখকে হাতে করে বেঁকিয়ে ৯০° কোণ করে রেখে সামনে তাকাতে হয়, নাহলে বরফের উপর আলোর radiation সরাসরি চোখের কর্ণিয়া নষ্ট করে একদম অন্ধ করে দেবে। পর্বতারোহীরাও দেখবে এক বিশেষ ধরণের Sunglass পরে। কিন্তু সাধু-সন্তরা ওসব পাবে কোথায় ? তাই তারা আত্মরক্ষার উপায় নিজেরাই বের করে নিয়েছে। এছাড়া সবসময় ঝুরঝুর করে বরফ ঝরে, ফলে চোখের পাতায় বরফগুঁড়ো জমে আর অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় তুমি চোখের পেশীর সাহায্যে চোখ খুলতেও পারবে না, হাতে করেই চোখকে খুলে রাখতে হয়।
ত্রাটক বিদ্যা জানা থাকার ফলে একবার দৃষ্টিপাত করলেই বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়—এমনি উঁচু-নীচু হলেও দেখা যায়। ব্যাপারটা কি রকম জানো—আমাদের দৃষ্টি সাধারণভাবে সরাসরি অর্থাৎ চোখ থেকে যতদূরে যায় তত ছড়িয়ে যায়। আর ঐ বিদ্যায় এটাকে করা হয় অভিসারী অর্থাৎ দূরের বস্তুর দিকে দৃষ্টি আরও একাগ্র হবে ফলে সেটাকে আরও নিখুঁত এবং স্পষ্ট দেখা যাবে। শকুন এই পদ্ধতিই অবলম্বন করে। অনেক উঁচুতে ওঠে এবং মৃত জীবজন্তু খুঁজে বেড়ায় আর ঐরকম অভিসারী দৃষ্টির সাহায্যে দেহটাকে বিশাল এবং স্পষ্ট দেখে। ফলে দেহটা মৃত না জীবিত তা নিখুঁতভাবে বুঝতে পেরে তবেই নীচে নেমে আসে। অবধূত শকুনের কাছ থেকেই এই বিদ্যা শিখে পরম্পরাগতভাবে পরবর্তীকালে তা চালু করেছেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনে এরকম একবার ঘটেছিল। উনি আদালতে সাক্ষী দেবার সময় কোর্টে উপবিষ্ট তৎকালীন ইংরেজ অফিসার বা জজসাহেবের সামনে তাঁর দূরদৃষ্টি ক্ষমতার দ্বারা বলে দিয়েছিলেন যে, সেখান থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা গাছের কাণ্ড বেয়ে পিঁপড়ের সারি খাদ্য মুখে নিয়ে উঠছে। সাহেবরা ঘটনার সত্যতা প্রমাণের জন্য ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দেন এবং তারা গিয়ে দেখে লোকনাথবাবা যা বলেছিলেন তা নিখুঁতভাবে সত্য।
লোকনাথবাবাও তো হিমালয়ে দীর্ঘদিন ছিলেন। উনি বরফের রাজত্বে কয়েকবছর কাটিয়েছিলেন। উনার সাথে ত্রৈলঙ্গ স্বামী এবং ইরাকের বিখ্যাত সুফীসাধক আব্দুল গফুরও (যিনি সুফী সম্প্রদায়ের প্রবক্তা) ছিলেন। এমনও শোনা যায় যে, ওনারা তিব্বত হয়ে সাইবেরিয়ার উপর দিয়ে আলাস্কা রেঞ্জ পার হয়ে নরওয়ে হয়ে উত্তর মেরু পর্যন্ত গিয়েছিলেন।