জিজ্ঞাসা : অত কষ্ট করে প্রাণ হাতে নিয়ে সাধু-সন্ন্যাসীরা ওসব যোগাড়ই বা করতে যান কেন ?
গুরুমহারাজ : দ্যাখো শাস্ত্রে রয়েছে—‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম সাধনম্’, শরীর দিয়েই তো সাধনা—শরীর না থাকলে আর কিসের সাধন ? আর শরীরে বল না থাকলে তখন আর সাধন হয় না- তখন ভজন। তবে ভজনের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়—আত্মসাক্ষাৎকার তো হয় না ! ফলে সাধন করতে হবে আর সাধন করতে হলে সাধনসমরে নামতে হবে।
যাইহোক এজন্যই সাধু-সন্তদের শরীর রক্ষা করার প্রয়োজন । শুধু শুধু শরীরপাত করাটা তো কাপুরুষতা অথবা অজ্ঞানতা। অবশ্য শরীরপাতের উদ্দেশ্য যদি ভগবান লাভ হয়, তাহলে তার ঊর্ধ্বগতি হয়, অন্যথায় তো প্রেতযোনিপ্রাপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। এরকম আমি একজনকে দেখেছিলাম বৃন্দাবনে। একটি তরুণ সন্ন্যাসী ঈশ্বর দর্শনের সংকল্প নিয়ে প্রায়োপবেশনে শরীর ত্যাগ করতে বসেছিল। বহু সাধু-সন্ন্যাসী, মণ্ডলেশ্বর, মহামণ্ডলেশ্বর এসেছিলেন তাকে request করতে যাতে সে অন্নজল গ্রহণ করে, কিন্তু ছেলেটি রাজি হয়নি। আমিও গিয়েছিলাম দেখা করতে। সবার জিজ্ঞাসার উত্তরে ও শুধু একটা কথাই বলছিল যে, ঈশ্বর তো সবই দেখছেন—তাঁকে দেখার সংকল্প নিয়ে যদি মারাই যাই—যদি এ জীবনে তাঁকে দেখতে নাই পাই, তাহলে পরের জীবনে আরও প্রথম থেকেই চেষ্টা করতে পারবো—এ শরীরটা দিয়ে এ জীবনে আর কিছু হবে না। তা দিন ১৫ পর ছেলেটি মারা গিয়েছিল।
এরকম দু-একটা ঘটনা ছাড়া বেশীরভাগ তো তামসিক ভক্তি। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের গল্প শুনে কোন এক ডাকাত “মা দেখা দে— দেখা দে” করতে করতে খাঁড়া নিয়ে দিয়েছিল গলায় এক কোপ। ব্যস্ সারা হয়ে গেল ! আরে ক্ষণিক আবেগ-উত্তেজনায় কি মা প্রসন্ন হয় ? ঠাকুরের সমগ্র জীবনের ত্যাগ-বৈরাগ্য ও সাধনার গভীরতা দেখল না—শুধু গলায় খাঁড়া লাগানো দেখল, তাই ঐ রকমই গতি হল। তবে ঠাকুরকে চিন্তা করে মারা গেছে তো—পরবর্তী জন্মটা ভালো হবে। আর ঐ ছেলেটির কথা বললাম ওর পরবর্তী নতুন শরীরেই আত্মসাক্ষাৎকার ঘটবে।
যাইহোক যে কথা বলছিলাম—সেই কথায় ফিরে আসি। সাধু-সন্তরা রেগুলার খাবার পান না। সবাই ভিক্ষা করতেও যান না। যাঁরা সূর্যবিজ্ঞান জানেন, তাঁদের অত খাওয়ার দরকার হয় না। কিছু আছেন পও-আহারী বাবা, এঁদেরও খুব একটা খাদ্যের দরকার হয় না। কিন্তু সবাই তো হঠযোগ অবলম্বন করেন না। জ্ঞানমার্গী, ভক্তিমার্গী—বিভিন্ন ধরণের সাধু রয়েছেন, এঁদের খাদ্যের প্রয়োজন হয়। তাই খাদ্য যেখানে নেই অথচ শরীরের পুষ্টিরও প্রয়োজন— বিশেষত শরীর রক্ষার জন্য, এসব কারণে শিলাজিৎ জোগাড় করে রাখেন। তাছাড়া অপর কোন মুমূর্ষু ব্যক্তির কাজে লাগতে পারে ভেবেও অনেক সময় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এসব সংগ্রহ করেন।
পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে পড়বে, দেখবে যে লোকালয় দিয়ে একজন প্রাচীন সন্ন্যাসী হেঁটে চলেছেন, তাঁর হাতে একটি চিমটি ও একটি কমণ্ডুল। গ্রামে-গঞ্জে যেখানেই মুমূর্ষু-রোগাক্রান্ত মানুষ দেখেছেন সেখানেই ঐ কমণ্ডুল থেকে জল নিয়ে মুখে-চোখে দিয়ে দিচ্ছেন আর তারা প্রাণ ফিরে পাচ্ছে কিংবা রোগমুক্তি ঘটছে।
এখানে বিজ্ঞানটা কি বলো তো ? ঋষির কমণ্ডুলতে রয়েছে highly Potentised খাদ্য, যার কয়েক ফোঁটাতেই মুমূর্ষু রোগীও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে বা জরা-ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিও লড়াই করার ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে। বর্তমানে কোরামিন বা অন্যান্য Life saving drug যে কাজ করে, তার থেকেও ভাল ফল পাওয়া যেতো। এগুলো কি থেকে তৈরি করতেন জানো—সোমলতার রসের নির্যাস, ঐ শিলাজিৎ, কৃকলাস বা ক্যাকলাস ফলের নির্যাস, মৃতসঞ্জীবনী বা জিনসান গাছের নির্যাস। এগুলিকে মধুর মধ্যে সংরক্ষণ করে রাখা হত ফলে নষ্ট হত না। তাহলে বুঝতে পারছো এর কি সাংঘাতিক খাদ্যগুণ ! এক গণ্ডুষ পান করা মানেই একটা পূর্ণবয়স্ক দেহে ১৫ দিনের খাদ্যগুণ জুগিয়ে যাওয়া।