জিজ্ঞাসু : সন্ন্যাসীটি নৃত্যের মাধ্যমে কি বলছিলেন ?

গুরুমহারাজ : উনি বলছিলেন, ‘এই সমস্ত ধর্ম আলোচনার আসর হচ্ছে ভণ্ডদের আসর। এর মাধ্যমে কখনই প্রকৃত ধর্মশিক্ষা হয় না আর প্রকৃত ধার্মিকেরা এইরকম আসরে কখনও বক্তব্যও রাখেন না। স্টেজ-এর উপর যারা আছে তারা সবাই ভণ্ড, নীচে দেখছি দু-একজনের মুখ পুড়েছে।’ এই ধরণের সব কথা বলে যাচ্ছিলেন নৃত্যের ভঙ্গিমায় ।

কিন্তু বক্তব্য যাইহোক, সেই নয়নভোলানো মনোমুগ্ধকর নৃত্য দেখে হাজার হাজার সাধু-সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী একদম মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। আমার ইচ্ছা ছিল ওনার সাথে একটু আলাপ করার, সুযোগও খুঁজছিলাম, ভাবলাম অনুষ্ঠানের শেষে যখন খাওয়া-দাওয়া হবে সেই সুযোগে ওনার সাথে কথা বলব। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কি হল জানো, নৃত্য শেষ হতেই খাবার ঘণ্টা পড়ে গেল আর ক্ষুধার্ত সাধু-ব্রহ্মচারীর দল হইহই করে উঠে পড়লেন। আমরা কৈলাস আশ্রমের প্রতিনিধিরা বসেছিলাম সামনের সারিতে কিন্তু আমাদের মণ্ডলেশ্বর তখনও স্টেজে বসে। তিনি না উঠলে আমরা উঠতে পারি না, এটাই বিধি ফলে আমাদের উঠতে একটু দেরি হল। সেই ফাঁকেই তিনি কোথায় যে চলে গেলেন আর কেউ তাঁর খোঁজ দিতে পারলেন না।

এখানকার মধ্যে আমি উদয়শঙ্কর-এর নাচ দেখেছি এবং আর একজন দক্ষিণী মেয়ের নাচ দেখলাম ইউরোপে, প্রোগ্রাম হচ্ছিল ভারত-উৎসব। ওখানেই দেখলাম বেশ ভালো লেগেছিল। তবে ঐ রকম সিদ্ধ আর কোথায় ? এখানে অনেকে আসে যারা নাচ শেখে, তাদের সাথে বিভিন্ন আলোচনা হয়। বলাগড়ের একটি মেয়ে ভালো নাচ জানে ও বিভিন্ন নাচের মুদ্রা জেনে গিয়ে সেগুলো stage Performance-ও করছে। তাণ্ডব নৃত্যটা ওর খুব শেখার ইচ্ছা, আমি বলেছি মায়ের ইচ্ছা হলে হবে।

এইতো অনেকগুলি কলার কথা হল, এছাড়া রয়েছে সমরকলা অর্থাৎ যুদ্ধবিদ্যা। এই কলায় সিদ্ধরা যে কোন রণকৌশল দ্রুত রপ্ত করে শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে পারে সহজেই। শিবাজী সমরকলায় সিদ্ধ ছিলো, ওর গুরু রামদাস ওকে এটা শিখিয়ে ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ ষোলকলায় পূর্ণ। এক-একটা কলার আবার ৪টি করে ভাগ—এই মোট ৬৪ কলায় সিদ্ধ শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর ব্যবহৃত Martial Art-এর বিভিন্ন শিক্ষা গুরু পরম্পরায় রয়েছে যে সমস্ত রামদাস জানতেন, উনি সেগুলো শিবাজীকে শিখিয়েছিলেন। ফলে ইতিহাসে পাবে যে, মুঘলসৈন্য বেশ কয়েকবার শিবাজীকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল, কিন্তু কোনবারই তারা শিবাজীকে ধরতে তো পারেই নি—অস্ত্রাঘাতও করতে পারেনি। ২৪/২৫ ফুট লাফাতে পারতো শিবাজী। নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে ২৪ ফুট দূরে বিপক্ষের ঘোড়সওয়ারের বুকে লাথি মেরে তাকে ফেলে তার ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারতো। আবার চারিদিক থেকে ওর উপর বর্শা পড়ছে—কি তীর আসছে তখন ঘোড়ার পিঠ থেকে খাড়া উঁচুতে ৮/১০ ফুট লাফিয়ে উঠে আবার নেমে বসে পড়ত ঘোড়ার পিঠে। দ্যাখো না ঔরঙ্গজেব ওকে কৌশলে বন্দী করল সেখান থেকেও পালিয়ে এল। এ যেন বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘের মুখ থেকে ফিরে আসার থেকেও কঠিন কাজ। তবে এই যে স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব মেনে নেওয়া এর পিছনেও গুরু রামদাসের শিক্ষা ছিল। ওর উপর গুরুর নির্দেশ ছিল-ে —যেমন করে কংসের রাজদরবারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একা Martial Art প্রয়োগ করে কংসকে হত্যা করেছিলেন তেমনি ঔরঙ্গজেবকে হত্যা করাই ছিল শিবাজীর উদ্দেশ্য। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের কাছে গুপ্তচরদের report ছিল যে, শিবাজী ২০/২৫ ফুট লাফাতে পারে, তাই ধূর্ত ঔরঙ্গজেব সর্বদাই নিজের সম্বন্ধে সচেতন থাকত এবং কাউকে বিশ্বাস করতো না। দু’চারদিন অন্তর দেহরক্ষী বদল করতো। যাইহোক্ ও শিবাজীকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় নিয়ে এল, যদিও শর্ত ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য ওকে সভায় আনা হবে। কিন্তু ঔরঙ্গজেব সে শর্ত রাখেনি। জয়সিংহ, যশোবন্তসিংহ প্রভৃতি হিন্দু সভাসদ শিবাজীকে ঔরঙ্গজেবের কথায় বিশ্বাস করে তার কাছে নিয়ে এসেছিল, তারা এই ঘটনায় খুব দুঃখিত হয়েছিল, কিন্তু করার কোন উপায় ছিল না। শিবাজী যখন দেখল যে, তার পরিকল্পনা ব্যর্থ তখন কৌশলে পালিয়ে গেল। এই ধরণের ইতিহাস সার্বিকভাবে লেখা হয়নি—হলে শিবাজীর মতো বীরদের গৌরবে ভারতবাসীর গর্বে বুক ভরে উঠতো। স্বামী বিবেকানন্দের একজন মারাঠী শিষ্য ছিলেন, যিনি পরে সন্ন্যাস ও নিয়েছিলেন। প্রথম পরিচয়েই স্বামীজী তাঁকে মারাঠাজাতির গৌরব —শিবাজীর কথা বলতে শুরু করলেন। কিন্তু ছেলেটি শিবাজীর সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করায় স্বামীজী খুব রেগে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি যখন শিবাজীর প্রকৃত ঘটনাগুলো বলতে থাকলেন তখন তিনি অবাক। বলছিলেন—স্বামীজী আমি মারাঠী হয়ে এত কথা জানি না। আর আপনি এসব কি করে জানলেন। যাইহোক্ সেই থেকে ছেলেটির মধ্যে শিবাজী সম্বন্ধে ভুল ধারণা ভেঙে যায়।