জিজ্ঞাসু : আশ্চর্য ! বিশ্বাসই করা মুস্কিল এসব কথা ! কিন্তু রামানন্দ অবধূতের মতো একজন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের কথা তো আর মিথ্যা নয়। কাজেই বিশ্বাস করতেই হচ্ছে !

গুরুমহারাজ : হ্যাঁ, আমার গুরুদেব রামানন্দ অবধূত ব্রহ্মজ্ঞপুরুষ ছিলেন। তিনি নির্বিকল্প সমাধির কথা বলতে গেলে বলতেন, “নিত্য নির্বিকল্পম্”। সবসময় জ্ঞানের চরম ভূমিতে বিরাজ করতেন—শরীরের প্রতিও কোনও নজর ছিল না বললেই চলে। এই অবস্থায় উনি প্রায় ১৬২ বছর বেঁচে ছিলেন। আমাকে যখন দীক্ষা দিয়েছিলেন তখনই ওনার বয়স ১৫৭ বছর মতো হবে। খুব ছোটবেলায় হিমালয়ে ঘোরার সময় এক তুষার ঝড়ের রাতে এক গুহার মধ্যে অন্ধকারে ওনার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। দেখা হয়েছিল বলতে—যোগীর চোখ তাই দেখতে পেয়েছিলেন, সাধারণ মানুষ হলে ঐ অন্ধকারে গুহার মধ্যে কি দেখবে—তাও কয়েক মিনিটের দেখা ! তার বহু পরে ১৫/১৬ বছর পর উত্তরকাশীতে ওনার আশ্রমে আমি যখন গেলাম, আমাকে দেখেই উনি এক chance-এ চিনতে পারলেন। ভাবো একবার ! কিশোর বয়স্ক একটি ছেলের ১৫ বছরে কতটা পরিবর্তন হয় শরীরের! দীর্ঘ ১৫ বছরের ব্যবধান হয়ে গেলে বাবা- মা চিনতে পারেনা সন্তানকে—এই নিয়ে কত উপন্যাস-সিনেমা পাবে। কিন্তু উনি দেখা মাত্রই আমাকে হিমালয়ের সেই তুষার ঝড়ের রাতের কথা মনে করিয়ে দিলেন। খুবই উন্নত অবস্থা ছিল ওনার। উত্তরকাশীতে যদি তোমরা কখনও যাও রামানন্দ অবধূতের কথা জানতে চাইলে দেখবে প্রবীণেরা শ্রদ্ধার সঙ্গে ওনার নাম উল্লেখ করবেন। গত ১৯৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৬শে জুন ওনার মহাপ্রয়াণ হয়। জান তো উনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দীক্ষা দিতে এসেছিলেন, কিন্তু ঠাকুরের সাথে কিছু কথা হবার পর উনি আবার হিমালয়ে ফিরে যান। তারপর বহুকাল অর্থাৎ প্রায় ১০০ বছর পর আমাকে দীক্ষা দিলেন। তাঁর এই দীর্ঘ জীবনে বহু সাধু-সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী ওনার কাছে দীক্ষা প্রার্থনা করেছিলেন কিন্তু উনি কাউকেই দেননি। সারাজীবনে আমিই ওনার একমাত্র সন্ন্যাসী শিষ্য। ওনার কাছে সন্ন্যাস দীক্ষা নিলেও উনি আমাকে সন্ন্যাস সংস্কারটা ঋষিকেশের কৈলাস আশ্রম থেকে করে নিতে বলেছিলেন। সন্ন্যাস সংস্কার করেছিলেন কৈলাস আশ্রমের অধ্যক্ষ স্বামী বিদ্যানন্দ গিরি। তবে “স্বামী পরমানন্দ” এই নাম গুরুদেব স্বামী রামানন্দ অবধূতই দেন। ঐ সময় আমি কয়েকমাস গুরুদেবের কাছে ছিলাম এবং ওনার সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলাম।

তখনই দেখেছিলাম গুরুদেব ছিলেন শিশুর মতো সরল। ওনার আবার নতুন করে দাঁত বেরিয়েছিল—অতিরিক্ত বয়সের জন্য। জ্ঞানী হলেও উনি যথার্থ প্রেমিক ছিলেন এবং আমাকে পুত্রের ন্যায় স্নেহ করতেন। স্নেহবশত মাঝে-মাঝেই আমাকে বলতেন, ‘এখানেই থেকে যাও—কি হবে জগতের জন্য কাজ করে ? ওরা মহাপুরুষদের বারে বারে মেরে ফেলেছে–তোমাকেও মারবে—আঘাত করবে। পৃথিবীগ্রহ এখনও শিশু অবস্থায় রয়েছে, মানুষের মানসিকতা এখনও উন্নত হয়নি। আমি বুঝতাম স্নেহের ছলে উনি আমাকে পরীক্ষা করছেন, ফলে চুপ করে থাকতাম। আবার বলতেন “জগ্ ঝুট্ হ্যায় কুত্তাকা পুছ্ হ্যায়” অর্থাৎ এ জগৎ মিথ্যা, এটা কুকুরের লেজের মতো যতক্ষণ ধরে থাকবে ততক্ষণই সোজা, ছেড়ে দিলেই আবার বাঁকা। এইভাবেই কত মহাপুরুষ, মহাজন জন্মগ্রহণ করেছেন, ভগবান অবতীর্ণ হয়েছেন নানা যুগে—নানা রূপে, বহু মানুষ তাঁর ভাব ও আদর্শকে গ্রহণ করে ধন্য হয়েছে। আবার বেশীর ভাগ তাঁকে গ্রহণ করেনি, যে কে সেই রয়ে গেছে। ফলে পৃথিবীতে অন্যায় বলে যেগুলো প্রচলিত, সেগুলোর তো কই অবসান হয়নি! রাম জন্মেছেন, কৃষ্ণ লীলা করেছেন, এসেছেন ভগবান বুদ্ধ, যীশু, শ্রীচৈতন্য, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ—এসেছেন তারুণ্যের প্রতীক—শিবজ্ঞানে জীবসেবায় নিবেদিত প্রাণ, সন্ন্যাসীকুলের আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁরা মুখের রক্ত, বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন সমাজের মানুষকে তুলে ধরার জন্য, বলেছেন “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত” । কিন্তু বাইরের দৃষ্টিতে কি মনে হয় না যে, জগৎ‍ যে কে সেই আছে ! তোমরা হয়তো বলবে বিবর্তনে এগিয়ে এসেছে সমাজ কিন্তু সে তো প্রকৃতির নিয়মে, তাহলে বিশেষ মহাপুরুষদের আগমনের কি প্রয়োজন বা উপযোগিতা ? এটাও একটা নিয়মে বাঁধা তবে সেটা প্রাকৃতিক বা জাগতিক নিয়ম নয়—এটা মহাজাগতিক বা মহাপ্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে পড়ে।

যাইহোক আমি গুরুদেবকে বলেছিলাম যে, হ্যাঁ কুকুরের লেজ কখনও সোজা হয় না, টেনে ধরে থাকলে কিছুক্ষণ সোজা থাকে কিন্তু তারপর আবার বেঁকে যায়—একথা সত্য। কিন্তু কুকুরের লেজ কখনও কখনও নীচের দিকে বাঁকে যখন তারা ভয় পায় বা নিজেদেরকে হীন ভাবে। আর কখনও কখনও উপর দিকে বাঁকা থাকে যখন সাহস সঞ্চয় করে বা বীরভাবে থাকে। তা আমি সমাজে গিয়ে অন্তত লেজটাকে উপরের দিকে তুলে দিয়ে আসি। একথা শুনে উনি হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়লেন। বললেন তোমার সাথে কথায় পারা যাবে না।

বেশ কিছুদিন হয়ে গেল—উনি আমাকে নীচে ফিরে আসার অনুমতি দিচ্ছেন না দেখে আমি একদিন ফিরে আসার কথা পাড়লাম, উনি আমাকে শেষ পরীক্ষা করার জন্য একটা গল্পের অবতারণা করলেন। গল্পটা হচ্ছে অরণ্য সংলগ্ন এক পর্বতের গুহায় একটি সাধু বাস করতেন। সাধনায় নিমগ্ন সাধুটির পূর্ণত্ব প্রাপ্তির জন্য যেটুকু সাধনা বাকী ছিল তা ঐ জন্মেই তাঁর শেষ করার সংকল্প ছিল এবং হয়েও যেত। কিন্তু মাঝখান থেকে একদিন একটা ঘটনা ঘটে গেল, হল কি—একটি ক্ষুধার্ত বাঘ একটা হরিণকে তাড়া করে নিয়ে আসতে আসতে একেবারে ঐ সাধুটির গুহার কাছে হাজির। প্রাণভয়ে ভীত হরিণ সাধুটির দিকে করুণ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েই গুহার মধ্যে আশ্রয় নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঘ এসে হাজির। বাঘ জিজ্ঞাসা করল, ‘হরিণ কোথায় ?’ আশ্রিতকে আশ্রয় দেওয়া বা রক্ষা করা সাধুর কর্তব্য, অতএব সন্ন্যাসী বললেন তিনি জানেন না। বাঘ চলে গেল। হরিণও মুক্তি পেয়ে আনন্দ করতে করতে চলে গেল। জীবনের বাকী কটা দিন সাধনার গভীরে ডুব দিয়ে সাধুবাবা অন্তিম দিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে সেই দিন এসে গেল কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁকে নিতে এল যমদূত। সাধুটি বললেন তাঁর তো মুক্তি হবার কথা, আর তো তাঁর জন্ম হবে না। যমদূত বলল “সাধুবাবা আমার উপর ধর্মরাজের যা আদেশ আমি তাই পালন করছি—আপনার যা বলার সেখানেই বলবেন।” এই বলে তাঁকে ধরে নিয়ে গেল যমরাজের কাছে। সেখানে সাধুটি তাঁকে পুনরায় ওখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় ধর্মরাজ তাকে ঐ দিনটির কথা স্মরণ করালেন। সাধু বললেন তিনি তো কোন অন্যায় করেননি কারণ হরিণ তো রক্ষা পেয়েছে—কাজেই ধৰ্মত ঠিক কাজই হয়েছে। ধর্মরাজ বললেন, ‘হরিণ রক্ষা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু বাঘটির মৃত্যু ঘটেছে, কারণ ঈশ্বরের নিয়মে ঐ দিন ঐ হরিণটিই ছিল বাঘটির ভক্ষ্য, তাকে লুকিয়ে রেখে ঈশ্বরের বিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে, তাছাড়া বাঘটির সঙ্গে মিথ্যাচার করা হয়েছে। এতগুলো অন্যায় কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তাঁকে আবার শরীর নিতে হবে এবং পুনরায় সাধনা করতে হবে।’

ফলস্বরূপ সাধুটির আবার নতুন শরীর হল, সে জীবনেও তিনি সন্ন্যাসী হয়ে ঐ একই গুহায় ধ্যান, জপ করে সাধুজীবন কাটাতে লাগলেন। তারপর একদিন ঠিক আগের মতোই একটা ক্ষুধার্ত বাঘ একটা হরিণকে তাড়া করে গুহার সামনে এল। হরিণ আশ্রয় ভিক্ষা করে ঐ গুহার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ল এবং একটু পরেই বাঘ এসে হরিণের সন্ধান চাইল। এবার কিন্তু সাধুবাবা বাঘটিকে হরিণের সংবাদ বলে দিলেন, ফলে মহানন্দে বাঘ হরিণটিকে মেরে মুখে করে নিয়ে আনন্দ করতে করতে চলে গেল। এবারও মৃত্যুর পর সেই যমদূত আবার এসে উপস্থিত এবং কোন কথা না শুনে একেবারে ধর্মরাজের কাছে নিয়ে হাজির হল সাধুটিকে। সাধুটি তাঁর কাছে এবারও তাঁকে সেখানে আনার কারণ জানতে চাইলে, ধর্মরাজ উত্তর দিলেন, ‘আশ্রিতকে সাধুর রক্ষা করা কর্তব্য, কিন্তু তা না করেই একটা নিরীহ হরিণের প্রাণনাশ হয়েছে—সেই কর্মফল মেটাতে আবার শরীর নিতে হবে।’ সুতরাং আবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ফিরে গিয়ে সাধুটিকে নতুন শরীর নিতে হল এবং শৈশব, বাল্য, কৈশোর কাটিয়ে সন্ন্যাসধর্ম অবলম্বন করে ‘কার্যকারণ’ সূত্রে সেই একই গুহায় সাধনা করতে শুরু করলেন। জীবন-সায়াহ্নে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। এবার কিন্তু সাধুটি হরিণকেও কিছু বললেন না, বাঘকেও কিছু বললেন না, নিজের ভাবে সাধনা করতে লাগলেন। ফলে এবার আর কোন কর্মফল হল না এবং সাধুটির মুক্তি ঘটল।

এই গল্পটা বলার পর গুরুদেব আমাকে বললেন, ‘দেখলে তো বৎস, কি সাংঘাতিক এই কর্মফলের ব্যাপার, কত তুচ্ছ ঘটনার কত বড় মাশুল দিতে হল। এইভাবে শত শত জন্ম লেগে যায় কর্মফল মেটাতে। সুতরাং এইতো জগৎ—কি আছে এতে ?’ আমি কোন উত্তর না দিয়ে নীরবে বসে বসে তাঁর সেবা করে যেতে লাগলাম । অনেকক্ষণ পর উনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন—’কিছু উত্তর দিচ্ছ না যে।’ আমি বললাম, ভগবন্। আপনি জ্ঞানী, সুতরাং আপনি জ্ঞাত আছেন যে, জগতে আপনারই বা কি ভূমিকা আর আমারই বা কি ভূমিকা, তবু যখন আপনি জানতে চাইছেন তাই আমি ঐ গল্পেই ফিরে যাবো। আপনার গল্পের সন্ন্যাসীটির স্থানে যদি আমি হতাম, তাহলে প্রথমবার যখন হরিণটি প্রাণভয়ে গুহায় আশ্রয় নিতে এসেছিল তখন তাকে সেখানে আশ্রয় দিতাম। আর ক্ষুধার্ত বাঘটি যখন হরিণকে খুঁজতে এসেছিল তখন তাকে সত্য কথা বলতাম আর নিজেকে বাঘের কাছে নিবেদন করে দিতাম। অর্থাৎ বাঘকে বলতাম হরিণের প্রাণভিক্ষা দাও আর আমার দেহের মাংস গ্রহণ করে তোমার ক্ষুন্নিবৃত্তি কর।
একথা শুনে গুরুদেব কাঁদতে লাগলেন, সমস্ত স্নেহ ঝেড়ে ফেলে তিনি একলাফে বিছানা থেকে উঠে পড়ে আমাকে বহুক্ষণ ধরে আলিঙ্গন করলেন। তারপর মস্তক চুম্বন করে মাথায় হাত দিয়ে আমাকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘যাও —এই হচ্ছে বিশুদ্ধ বাউল ভাব, এই ভাব অবলম্বন করে সমাজে কাজ করো। তোমার এই শরীর দিয়ে হাজার হাজার মানুষের কল্যাণ হবে, সমাজের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হবে। গুরুকুল তোমার সহায়।’ এই ঘটনার পর আমি বনগ্রামে ফিরে আসি এবং আশ্রমের কাজ শুরু হয়। তবে দেখেছি উনি কথার খেলাপ করেননি, যখনই কোন অসুবিধা হয় বা সমস্যায় ড়—গুরুদেব প্রকট হ’ন। অনেক সময় সঙ্গী-সাথী অর্থাৎ গুরুকুলের পড়ি- অন্যরাও সাথে থাকে। কিছুক্ষণ কাটানোর পর আবার চলে যান।