জিজ্ঞাসু : গুরুমহারাজ! অনেক মহাপুরুষের জীবনকাহিনী পড়েছি, কিন্তু চাক্ষুষ এভাবে কোন মহাজীবনকে তো কখনও দেখিনি, তাই আপনার কথা শুনতে শুনতে এক-এক সময় মনটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। যাইহোক একটু আগে আপনি আপনার আগের কোন জন্মের হাতি শরীর বা হনুমান শরীরের কথা বলছিলেন এটা কি মনে রাখা সম্ভব ?
গুরুমহারাজ : কেন নয় ? তবে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে একটা জীবনের সব ঘটনাই স্মৃতিতে থাকে না, তাই পূর্ব পূর্ব জীবনের ঘটনা স্মৃতিতে থাকা তো সম্ভব নয়ই। আর এই জন্যই তোমাদের হয়তো মানতে কষ্ট হচ্ছে আমার কথা। কিন্তু এর বিজ্ঞানটা বলছি শোন। স্মৃতিশক্তির রহস্য হচ্ছে ব্রহ্মচর্য। ব্রহ্মচর্য মানে শুধুই বীর্যধারণ নয়, তবে এটা মুখ্য, আর এছাড়াও কায়-মনো-বাক্যে যদি কেউ মৈথুন বর্জন করতে পারে অর্থাৎ ১২ বছর যদি সে অস্খলিত ব্রহ্মচর্য পালন করতে পারে তাহলে তার মেধানাড়ী খুলে যায়। এই অবস্থায় মস্তিষ্কের বহু প্রসুপ্ত কোষ ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, যেগুলি সাধারণ মানুষের জীবনে কখনই কার্যকরী হয় না। তাই মানুষ কোষগুলির কার্যকারিতার কথা জানতেই পারে না। আর ঐ কোষগুলিকে open করার বা ক্রিয়াশীল করার একমাত্র উপায় হচ্ছে গুরুপ্রদত্ত বিশেষ যোগ শিক্ষার অনুশীলন। যার মধ্যে Food habit এবং Life style এর control ও সেই সঙ্গে আসন, প্রাণায়াম, ধ্যান ইত্যাদি যা কিছু রয়েছে সবই তোমাকে করতে হবে। এর কোন back-door নেই । যে মতের বা যে পথেরই হওনা কেন—ঠিক ঠিক Perfection এর জন্য তোমাকে ঐ একটাই পথ অবলম্বন করতে হবে। সেইজন্যই আমি বলি ভিন্ন ভিন্ন মত কিন্তু পথ একটাই।
এভাবে নিত্য অভ্যাসযোগের ফলে জীবনের জটিলতার জটগুলো খুলতে থাকবে। এক-একটা জীবন যেন এক-একটা অভিজ্ঞতার সোপান বা সিঁড়ি। যে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে মানুষ এগিয়ে চলেছে পূর্ণত্বের দিকে। এটাকেই ‘চরৈবেতি’ বলা হয়েছে। এইবার এই যে এক-একটা জন্ম বা জীবনকাল ও মৃত্যু, এই নিয়ে এক-একটা জীবনচক্র। আর প্রতিটি জীবনচক্রে লব্ধ অভিজ্ঞতার gist জমা হচ্ছে পরবর্তী শরীর গ্রহণের কারণরূপে। কিন্তু মৃত্যু মানেই এক ঘন সুষুপ্তি, যা ভুলিয়ে দিচ্ছে এই জন্মের স্মৃতিকে। পরবর্তী জন্মের প্রথম পাঁচ বছরে কিছু কিছু পূর্বজন্মের স্মৃতি থাকে, কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান জীবনের পরিবেশ, পরিস্থিতি, ঘটনাপ্রবাহে তাও ম্লান হয়ে যাচ্ছে । এইভাবে এক-একটা জীবনকালের স্মৃতি আর মৃত্যুর পর বিস্মৃতি—এইভাবে পর পর লক্ষ লক্ষ জীবনের স্মৃতি এবং বিস্মৃতি নিয়েই কিন্তু তোমার-আমার সবার দীর্ঘ জীবনযাত্রা। সাধারণত আমরা যে একটা মানুষকে শুধু তার একটা জীবন দিয়েই বিচার করে থাকি—এটা ভুল। তাই সবসময় তার জীবনের হিসাব- নিকাশ মেলাতেও পারি না। এটা জেনে রাখবে যে, একটা জীবন দিয়ে কোন ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা কি তা জানা যায়না, জ্ঞানীরা এটা জানেন, তাই দেখবে এমন অনেক ব্যক্তিকে হয়তো তিনি খুব ভালোবাসেন যার এজন্মে এমন কিছু সুকর্ম নেই আবার এমন কোন ব্যক্তিকে তিনি সহ্য করতে পারছেন না বা প্রাধান্য দিচ্ছেন না—যার এই জীবনের কর্ম ভালো ।
যাইহোক আমার ৬০,৪১৮টি জীবনের প্রতিটির স্মৃতি রয়েছে। স্মৃতির অতলে ডুবে ডুবুরীর মতো আমি একটি একটি করে স্মৃতিকণা collection করে নিয়ে এসে তোমাদের উপহার দিতে পারি। কিন্তু তাতে তোমাদের কোন উপকার হবে কি ? তা যদি হত, তাহলে নিশ্চয়ই তা করতাম। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভগবান বুদ্ধ জাতকের নানা গল্প বলেছিলেন যা তাঁর পূর্ব পূর্ব জীবনের বিভিন্ন ঘটনা। যেগুলি জাতকের গল্প হিসাবে মানুষ পড়ে। আর প্রতিটি গল্পের পিছনে হয়তো একটা নীতিশিক্ষা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার জন্য তো পঞ্চতন্ত্র পড়লেই হয়। তাই সেই মহান মানুষটির জীবন দিয়ে যে প্রকৃত শিক্ষা, যার জন্য তাঁর জাতকের গল্প বলা, সে দিকটা বেশীরভাগ মানুষের কাছে উপেক্ষিতই রয়ে গিয়েছে।
তবু ঘটনাটা বলছি। হাতি-শরীরে যখন আমি এসেছিলাম, তখন আমার মনে আছে আমি হাতিদের দলপতি ছিলাম। আমি যুবক হবার পর একদিন নারী হাতির অধিকার নিয়ে পূর্বের দলপতির সঙ্গে ভয়ঙ্কর লড়াই করেছিলাম। আরও দু-চারজন ঐ দলপতির হয়ে আমার বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। আমি বীর-বিক্রমে চার-পাঁচটা হাতির সাথে লড়াই করে ২/৩ দিন পর যখন বিজয়ী হলাম তখন দেখলাম নারী হাতিটি এই ২/৩ দিন ধরেই রণাঙ্গণে বিজয়ী হাতিটিকে অর্থাৎ আমার হাতি-শরীরটাকে বরণ করবে বলে অপেক্ষা করে রয়েছে। দলের বাকি হাতিরা একটু দূরে খাদ্যগ্রহণে ব্যস্ত আর আমার সাথে লড়াইয়ে পরাজিতরা নিদারুণ যন্ত্রণায় পড়ে পড়ে কাতরাচ্ছে। এসব দেখে আমার হাতি-মনে দারুণ বৈরাগ্য এ’ল। বুঝতে পারলাম নারীর জন্য পুরুষের লড়াই এ এক প্রাকৃতিক চিরন্তন নিয়ম। আর এর কারণ দুর্বলতা। আমারই প্রিয়জনদের করুণ অবস্থা দেখে দারুণ কষ্ট হল মনে। স্থির করলাম দলত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বন করাই শ্রেয়ঃ। এই ভেবে অন্যদিকে হাঁটা দিলাম। নারী হাতিটি অনেকদূর পিছন পিছন এসেছিল কিন্তু আমাকে আর ধরতে পারেনি। তারপর দলছুট মদ্দা হাতিদের নিয়ে আমি একটা সন্ন্যাসী হাতির দল বানালাম —যাদের কাজ আর্ত হাতিদের সেবা করা, দলছুটদের আশ্রয় দেওয়া, পাগলা হাতিদের চিকিৎসা করা ইত্যাদি। গতবার হিমালয়ে গিয়ে দেখলাম সেই পরম্পরা এখনও রয়েছে।