জিজ্ঞাসু : গুরুমহারাজ, আমরা অবাক হয়ে যাই এই ভেবে, যে কোন প্রসঙ্গ তা যাই হোক না কেন, আপনি তার আদ্যপ্রান্ত এমনভাবে বলতে থাকেন, যেন মনে হয় আপনি সব দেখে দেখে বলছেন!
গুরুমহারাজ : তা বলতে পারিস ! দেখে দেখে তো ! তবে হয়তো স্থূলদৃষ্টিতে নয়। হস্তমলকবৎ! জ্ঞান যখন হস্তমলকবৎ হবে তখন পৃথিবীর জ্ঞান বা পৃথিবীটাও তো হাতের মুঠোয়। তুই তখন দেখে দেখে বলনা – যা বলতে চাইছিস। ধারণা করতে পারছিস না তো ! ধী-শক্তি বাড়া, চিন্তার গভীরে ডুব দে—কথাগুলো ধরতে পারবি।
জিজ্ঞাসু : আচ্ছা মহারাজ, জীবনে দীক্ষা নেওয়া কি খুবই প্রয়োজন আর এরজন্য কি ব্রাহ্মণগুরু দরকার ?
গুরুমহারাজ : হ্যাঁ, জীবনে অগ্রগতির জন্য অর্থাৎ চেতনার উত্তরণের জন্য গুরুর একান্ত প্রয়োজন হয় মানবজীবনে। জৈবিক উদ্বর্তনের জন্যেও গুরুর দরকার হয় আর আত্মিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন হবে না !
তবে ঐ যে বললেন—ব্রাহ্মণশরীরের গুরু প্রয়োজন, এটা কি জাতিগত না প্রকৃত অর্থে ব্রাহ্মণের কথা বললেন। যদি জাতিভেদ প্রথাগত ব্রাহ্মণ অর্থাৎ বামুনের কথা বলেন, তাহলে আপনার ভাবনায় ভুল হচ্ছে। কারণ শাস্ত্রে রয়েছে “জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ, সংস্কারাৎ দ্বিজ উচ্যতে।/ বেদ পাঠাৎ ভবেৎ বিপ্রো, ব্রহ্ম জানাতি ব্রাহ্মণঃ ৷৷” যিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন, তিনিই ব্রাহ্মণ। এই অর্থে ‘ব্রহ্মবিদ গুরু’ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সদগুরু বলতে এঁদেরকেই বোঝানো হয়। তবে গুরু পরম্পরা রয়েছে, একটা লৌকিক পরম্পরা অন্যটি লোকোত্তর পরম্পরা। মানুষ লোক-পরম্পরা গুরুদের জানে, কিন্তু লোকোত্তর পরম্পরার গুরুদের কথা কি করে জানবে ? তাঁরাই এক-একটা পরম্পরার সৃষ্টি করে যান, যেখানে গুরুশক্তি পরম্পরাক্রমে বাহিত হয়। এই শক্তি ততদিন থাকে যতদিন না পরবর্তী পরম্পরার বাহকেরা ঐ পরম্পরার মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হ’ন। সাধারণত তিন Generation পর্যন্ত এই আদর্শ অটুট থাকে, তারপর থেকে fade হতে আরম্ভ করে এবং সাত generation-এর পর লক্ষ্যচ্যুত হয় যদি না তার মধ্যে আবার কোন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ এসে যান। যেমন বৌদ্ধ পরম্পরায় গৌতম বুদ্ধের পর আরও অনেকে ‘বুদ্ধ’ হয়েছিলেন। ফলে এঁরা বৌদ্ধ ধর্মমতের মূল আদর্শকে বহুদিন পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। গোরক্ষনাথ পরম্পরায় সব চাইতে বেশী ব্রহ্মজ্ঞপুরুষ শরীর নিয়েছিলেন, প্রায় ৮০ জন। এইভাবে এই পরম্পরাটিও মূল আদর্শকে বহুকাল টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু এসবের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে অর্থাৎ মা জগদম্বা যে পরম্পরার যতদিন প্রয়োজন ততদিন তাকে রাখে, না হলে কালের গর্ভে বিলীন করে দেয়, এখানে অন্য কারো কিছু করার নেই। যার জগৎ সে যেভাবে চালাবে সেভাবেই চলতে হবে তাইনা !
তবে আমাদের এখানে দেখো, ‘আমারই তো তথাকথিত ব্রাহ্মণ শরীর নয়, তবু মা এই শরীরটা দিয়ে কাজ করিয়ে নেবে বলেই হয়তো আমাকে দীক্ষা দিতে হচ্ছে। আমি তো ন’কাকাকে কতবার বলেছি দীক্ষা দেবার জন্য, হরি (স্বামী সহজানন্দ)-কে বলি, কিন্তু ওরা রাজী নয়। ওরা বলল, ‘তুমি থাকতে আমরা দীক্ষা দেব না’। আমার এখানে অব্রাহ্মণ শরীর অনেকেই আছে যারা এবার দীক্ষা দেবে।