জিজ্ঞাসু : আচ্ছা মহারাজ বলা হয় কলিযুগে নামেই মুক্তি, তাহলে অন্য কিছু না করে শুধু নাম করলেই তো হয় ?
গুরুমহারাজ : প্রথমেই জানতে হবে কলিযুগ বলতে কি বোঝায় ? কোন্ দিন বা কোন্ ক্ষণ দিয়ে কলিযুগের সময়কাল নির্ধারণ করবে ? আর সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এগুলোকেই বা কি করে নিগড়ে বাঁধবে ? অনেক পণ্ডিত মাথা ঘামিয়ে ঘামিয়ে কিছু তথ্য দিয়েছেন কিন্তু তার সারবত্তা কি আছে ? আচ্ছা সত্য বা ত্রেতা বা দ্বাপরে কি অনাচার, অধর্মাচার, অন্যায়, অশান্তি ছিল না ? সামান্য সামান্য কারণে মহা মহা যুদ্ধ হয়েছে, রাজবধূকে প্রকাশ্যে উলঙ্গ করার চেষ্টা হয়েছে, রাজবধূদের বা রাজকন্যাদের অন্য রাজারা জোর করে তুলে নিয়ে গেছে—ঘটেনি এসব ? সত্যযুগে মানুষ বিক্রি হতো—হরিশচন্দ্র স্ত্রী-পুত্রকে বিক্রি করছে বা নিজে বিক্রি হচ্ছে—এগুলিকে কি বলবে ? আর বললাম তো এসব রাজপরিবারের ইতিহাস, তাহলে সাধারণ আমজনতার জীবনের মান কিরূপ ছিল ভাব একবার ! সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কথা ইতিহাসকারেরা বা পুরাণকারেরা ঐ মানুষের গোচরে আনেইনি। কিন্তু তা না আনুক আমরা ঐ ঘটনাসমূহ পর্যালোচনা করে একটা ধারণা পেতে পারি নাকি ? তাই বাবা, কোন্ মানদণ্ড দিয়ে কলিযুগ বিচার করবে ? সবসময়ই প্রৌঢ়রা, বৃদ্ধরা, সংরক্ষণশীল ব্যক্তিরা তাদের সময়টাই ‘ভাল ছিল’ আর ‘বর্তমানটা খারাপ’ এরূপ বলে থাকে, কিন্তু সেটা যুক্তিযুক্ত কি ? অভিব্যক্তির বা ক্রমবিকাশের ধারা ধরে পৃথিবীগ্রহ এগিয়ে চলেছে Perfection এর দিকে। ফলে খারাপ হবে কেন—যতদিন যাবে ততই ভালো হবে।
আমি নৈরাশ্যবাদী নই—আমি নিত্য বর্তমানে থাকি, বর্তমানের পূজারী। ফলে বর্তমানকে ভয় পাইনা বরং আলিঙ্গন করি, কারণ জানি বর্তমানই ভবিষ্যতের রূপকার। যার বর্তমান ভালো হবে অবশ্যই তার ভবিষ্যৎও ভালো হবে তার অতীত যাই হোক না কেন ! এই সহজ সূত্রটা রয়েছে বলেই তো পৃথিবী এগিয়ে চলেছে সম্মুখপানে। আমি দেখেছি মানুষের মধ্যেই এই চারটি যুগের প্রভাব রয়েছে। যে মানুষ তার চেতনার যে অবস্থায় রয়েছে সেই অনুযায়ী সে কোন না কোন যুগে রয়েছে। যে কল্মষ বা কলুষতার অন্ধকারে রয়েছে, সে কলিযুগের লোক, সাধুসঙ্গ বা সৎসঙ্গের ফলে মানুষের যখন বিবেক জাগল—সভ্যতার পথে পদক্ষেপ শুরু হল তখন সে দ্বাপরের লোক অর্থাৎ দ্বিপদ প্রাপ্ত হয়েছে। তারপর সত্যবোধের জন্য যখন তার জীবনে সংগ্রাম শুরু হল, তখন সে ত্রেতার লোক। তারপর সংগ্রাম অন্তে জীবনে যখন সত্যবোধ হল তখন সে সত্যযুগে উপনীত হল। সুতরাং একটা মানবজীবনের মধ্যে চারটে যুগ আসতে পারে। সমাজেও কোন কোন সময় ঐ চার ধরণের স্বভাববিশিষ্ট মানুষের সংখ্যার কমবেশী হয়, ফলে হয়তো সেই অনুযায়ী কোন সময়ের সমাজকে সত্যযুগের সমাজ বা কোন সময়ের সমাজকে ত্রেতাযুগের সমাজ ইত্যাদি বলা হয়েছে। তবে এটা জানবে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই সমাজ, তাই ব্যক্তিই এখানে প্রধান। ব্যক্তি যদি সত্যযুগে অবস্থানকারী সত্যদ্রষ্টা বা তুরীয় স্বভাবের অধিকারী হন, তিনি মহাপুরুষ। ব্যক্তি যদি ত্রেতার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হন, তাহলে তিনি সত্ত্ব প্রধান বা বিবেকপরায়ণ সত্যনিষ্ঠ সাধক। যদি সে দ্বাপরের অর্থাৎ রজঃপ্রধান হয়, তাহলে সে ক্ষত্রিয়োচিত আচরণ করবে। প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সাহস, বীর্যপ্রকাশ ইত্যাদি তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হবে। আর ব্যক্তি যদি কলিহত হয়, তাহলে সে তমঃপ্রধান অর্থাৎ আলস্য, জাড্য, প্রমাদগ্রস্ত হবে। এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সংযম, নিষ্ঠা, বিবেক-বৈরাগ্য এসব একদমই থাকবে না। বিবেক- বৈরাগ্য না থাকায় এরা জ্ঞানযোগের অধিকারী নয় আবার সংকল্পের দৃঢ়তা, সহিষ্ণুতা, সংযম না থাকায় এরা রাজযোগের বা কর্মযোগেরও অধিকারী নয়। তাহলে বাকী থাকল ভক্তিযোগ। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব যখন নবদ্বীপে শরীর নিয়েছিলেন তখন বাংলাদেশে প্রচণ্ড তমোগুণের প্রভাব ছিল। মহাপ্রভু, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এঁরা হলেন সাক্ষাৎ ভগবান। প্রকৃত অধ্যাত্মবিজ্ঞানী এঁরাই। কারণ তাঁর জগতে কার কি অবস্থা আর কাকে কি ভাবে তুলতে হবে, রাখতে হবে, তাঁরা ছাড়া আর কে অত বেশী জানেন বা কার কিসে ভাল হবে, তার বিধান দিতে ওঁদের মতো কে পারেন ! ‘আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শেখায়’ এই নীতি অবলম্বন করে মহাপ্রভু কলিহত জীবের জন্য বললেন, ‘কেঁদে কেঁদে হরিনাম কর।’ তারপর তিনি তা কেমন করে করতে হবে এবং করলে কি হবে তা দেখিয়ে দিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের জীবন দিয়ে শেখালেন কত রকমের সাধনা এবং সেগুলি কত সহজে করা যায়। কিন্তু মানুষ মহাপুরুষের জীবনটা নিল কি ? ওঁদের শিক্ষা কিন্তু সবসময়ই জীবনমুখী হয়, তাও নিতে পারলো না। পরবর্তীকালে অনেক আচার্য এলেন, বললেন “এটা কলিকাল মহাপ্রভু বলে গেছেন ‘নাম কর’, আমিও বলছি ‘নাম করো’, ‘নামেই ভক্তিলাভ, নামেই মুক্তি’ ইত্যাদি সব কথা। কিন্তু এঁরা একবারও–কি করলে কি হবে, অর্থাৎ তার বিজ্ঞানটা কি, এই নির্দেশ কি করলেন ? আর করবেনই বা কি করে, নিজেদেরই ধারণা হয়নি। দু’চারটে সিদ্ধি অর্জন করে এক-একটা ভগবান হয়ে বসে পড়লেন। এবার শিষ্যদের বা ঐ পরম্পরায় বিশ্বাসী লোকেদের হল বিপদ। তাদের আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ তো ঘটলই না—উপরন্তু ভয়ানক গোঁড়া, ধর্মান্ধ সব অসুরে পরিণত হল যা ধর্মজগতের গ্লানি হয়ে দাঁড়াল।
আচ্ছা বলো তো শুধু নাম উচ্চারণ করলে কি হবে ? হাজার বছর ধরে ‘চিনি’ ‘চিনি’ বললে কি মুখ মিষ্টি হবে ? ভাগবতে আছে ‘নাম স্মরণম’ অর্থাৎ নাম স্মরণ, নাম-নামী অভেদ জ্ঞানে নাম করা বা জপ করা। বীজমন্ত্রেও ইষ্ট রয়েছে—তার জপ রয়েছে। অর্থাৎ বাচিক, মানসিক বা উপাংশু যে কোন ক্ষেত্রেই—নামের সঙ্গে নামীকে যেন স্মরণ হয়। তোমার ছেলের নাম উচ্চারণের সঙ্গে যেমন ছেলের স্মরণ হয় তেমনি জপ করতে করতেই ভগবৎ স্মরণ হয়ে যাবে আর স্মরণের গভীরতায় বৈখরীর নাম বন্ধ হয়ে গিয়ে তখন অন্তর্জগতে আপনা-আপনিই নাম চলতে থাকবে। এই অবস্থাকেই অর্ধবাহ্যদশা বলা হয়েছে। বাহ্যদশা, অর্ধবাহ্যদশা আর অন্তর্দশা—মহাপ্রভু এই তিন ভাবেই থাকতেন। বহিরঙ্গা, তটস্থা আর অন্তরঙ্গা। ‘বহিরঙ্গ সঙ্গ করে নাম সংকীর্তন, অন্তরঙ্গ সঙ্গে করে প্রেম আলাপন’–ফলে বহিরঙ্গটা শুরু আর প্রেমে শেষ। প্রেমই পরম পুরুষার্থ। কিন্তু এই লক্ষ্য কি থাকছে?
মুখে নাম আর অন্তরে কুচিন্তা – কি লাভ হবে বল দেখি ? ‘যাদৃশী ভাবনা ——যার যেমন ভাব তার তেমন লাভ’–ঠাকুর যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী’—“ শ্রীরামকৃষ্ণ একথা বলতেন। ভাবগ্রাহী জনার্দন ভাব দেখেন—ভাব গ্রহণ করেন, উচ্চারণ কি করল তা দেখেন না। কত সাধক আছে, তারা ইষ্টকে গালি-গালাজ করে, খিস্তি দেয়, কই ঈশ্বর তো কখনও তাদের উপর বিরূপ হন না ! বামাখ্যাপা তাঁর ইষ্টদেবীকে কত গালি-গালাজ করতেন কিন্তু তাতেও তাঁর ইষ্ট-সাক্ষাৎকার হয়েছিল। অধ্যাত্মবিজ্ঞানী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন ঊনপঞ্চাশ বর্ণরূপিণী মা তোমাকে প্রণাম। ঐ বর্ণ দিয়েই বেদ-বেদান্ত আবার ঐ বর্ণ দিয়েই খিস্তি-খেউড়। ব্যাপারটা –ঠাকুর কি বোঝালেন। সুতরাং বর্ণ বা শব্দ বড় কথা লক্ষ্য করো— নয়, ওটা তো একটা মাধ্যম, ভাষাও হচ্ছে ভাবপ্রকাশের মাধ্যম মাত্র। সুতরাং ভাষা বা উচ্চারণও বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে ভাব। ভাবনায় ভগবান থাকলেই ভগবৎ সাক্ষাৎকার হয়, নাহলে হাজার চিৎকার করলে বা খোল-খঞ্জনি বাজিয়ে লম্ফ-ঝম্প করলে কোন কিছুই লাভ হবে না ।
তাহলে নিশ্চয় নামের রহস্য বোঝা গেল ! এবার কথা হচ্ছে, যেসব গুরুরা শিষ্যদের প্রকৃত রহস্য না বুঝিয়ে শুধু ‘নাম কর’ ‘নাম কর’ করে, তাদের অপরাধ হয়। কারণ এদের দ্বারা হাজার হাজার মানুষ শুধু প্রভাবিত নয়—প্রতারিত হচ্ছে। এই অপরাধের জন্য তাদের শাস্তি গ্রহণ করতে হয়। বাবা আধ্যাত্মিক জগতের বিচিত্র বিধান !
যাইহোক্ এসব জেনে তোমাদের কাজ নেই। তোমরা শুধু এটা মনে রাখবে যে, জগতে যে সমস্ত মানুষ আছে, এদের সবাই কলিহত জীব নয়। এদের মধ্যে সবসময়ই তুরীয় স্বভাবের মানুষ থাকেন, তাঁরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে, কোন শাসন-বারণের মধ্যে তাঁরা পড়েন না। বরং তাঁরাই নতুন নতুন যুগোপযোগী পরম্পরা সৃষ্টি করেন। সাত্ত্বিক স্বভাবের মানুষ আছে, যারা জ্ঞানযোগ অবলম্বন করেও আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করতে পারে। রাজসিক প্রকৃতির মানুষ রয়েছে, যারা রাজযোগ অবলম্বন করে আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে পারে। এ ছাড়াও সাত্ত্বিক বা রাজসিক ব্যক্তিরা ‘বহুজন হিতায়’ ও ‘বহুজন সুখায়’ কর্ম করে অর্থাৎ লোকহিতকর কর্মে আত্মনিয়োগ করেও চেতনার উত্তরণ ঘটাতে পারে। কিন্তু তামসিক ব্যক্তি বা কলিহত জীব যদি আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য কোন সদগুরুর কাছে যায়, তাহলে তিনি তাকে কেঁদে কেঁদে ‘নাম’ করার বিধান দেন। সুতরাং ওটা কখনই ভেবো না যে, সকলকে এক ক্ষুরে মাথা কামাতে হবে বা সকলকে এক ছাঁচে ফেলে একই রকম বানাতে হবে। বৈচিত্র্যই প্রকৃতির ধর্ম, এখানে সবার জন্য এক নিয়ম—এই কথাটাই অর্থহীন। তাই যদি কেউ এটা বলে যে, ‘নাম ছাড়া গতি নেই’- জানবে সে হয় ভ্রান্ত অথবা আহাম্মক ছাড়া আর কিছু নয়।
আমি ছোটবেলা থেকেই অনেক হরিবাসর দেখেছি, কারণ আমার পূর্বাশ্রম ছিল কালনা-নবদ্বীপ সন্নিকটস্থ। ফলে ওখানে অষ্ট প্রহর, চব্বিশ প্রহর ইত্যাদি নানা হরিবাসরের অনুষ্ঠান লেগেই থাকত বা এখনও আছে। সেখানে দেখেছি বেশীর ভাগেরই হৈ হৈ লম্ফঝম্প সার। আবার অনেকেই ঐসব করতে করতেই ভাবাবেগসম্পন্ন হয়ে পড়ে। ওরাও দুর্বল। কিন্তু প্রকৃত ভগবদভাব নার্ভকে দুর্বল করে না-শক্তিশালী করে। অধ্যাত্মজগতে ইমোশন দরকার আছে প্রথম অবস্থায় কিন্তু emotion with sincerity (কপটতাহীন আবেগ) -কেই শ্রদ্ধা বলে, যা জ্ঞানলাভে সহায়তা করে। এইজন্যই বলা হয় ‘শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম্’। আর emotion without sincerity (আন্তরিকতাবিহীন ভাবাবেগ) হলেই সর্বনাশ । কারণ অতিরিক্ত excitement বা উত্তেজনায় মানুষ তার শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং পাগলের ন্যায় আচরণ করে ও মুর্ছা যায়। সবাই ভাবে—ভাব হয়েছে বা লোকটি আধ্যাত্মিক। কিন্তু তা নয়, ও যদি ঐ ভাবাবেগ সম্বরণ করতে না পারে, তাহলে পরে তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়বে এবং সে কঠিন ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। সেইজন্যই বলছিলাম emotion without sincerity একদম ভাল নয়। আবার দেখ In- telligence (বুদ্ধি) ভাল, কিন্তু তা যদি বিবেকযুক্ত হয়, তাহলে আরও ভাল। তাহলেই জ্ঞানলাভ সম্ভব। অন্যথায় Intelligence with- out conscience – nonsense হয়ে যাবে। তাই মস্তিষ্ক, হৃদয় ও পেশীশক্তির পূর্ণ বিকাশেই এই পূর্ণতা, আর তখনই মানবজীবনের সার্থকতা।