জিজ্ঞাসু : গুরুমহারাজ, আপনি সেদিন সাপ নিয়ে কথা বলছিলেন, আচ্ছা সাপ কি ক্রূর বা হিংস্র, কারণ কুটিল নারীকে সপিনীর সঙ্গে তুলনা করা হয় ? তাছাড়া সাপের প্রতিশোধেচ্ছা থাকে ? নাকি প্রচণ্ড

গুরুমহারাজ : দেখো, সাপ নিয়ে সমাজে বহু গাল-গল্প রয়েছে। আসলে মানুষ যাকে ভয় পায়, তাকে নিয়েই গড়ে ওঠে নানান কল্প-কাহিনী। কিন্তু আজকাল তো সাপ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে—কলকাতাতেই রয়েছে রিসার্চ সেন্টার। ফলে আজকের মানুষের আর উচিত নয় সাপ সম্বন্ধে আজগুবি ধারণা করা।
এমনিতে আমাদের এখানে যেসব বিষধর সাপ বাস করে তারা সাধারণত স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার এবং ঠাণ্ডা জায়গায় বসবাস করতে ভালবাসে। গৃহের আশেপাশে বা অভ্যন্তরে সাপ থাকার একমাত্র কারণ হচ্ছে—খাবারের প্রাচুর্য। কারণ গৃহকে কেন্দ্র করে ইঁদুর, টিকটিকি থাকবেই আর এদের খোঁজেই সাপ আসে এবং আহার ও আশ্রয় (ইঁদুর গর্ত) পেয়ে যায়। ফলে অনেক সময় সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে দেয়।

এবার কথা হচ্ছে, সাপ যদি হিংস্র হত তাহলে আমাদের কোন মানুষই কি বাঁচতো ? সাপ হিংস্র তো নয়ই বরং অত্যন্ত ভীতু স্বভাবের প্রাণী। ফোঁস করে ছোবল দেয় স্রেফ আত্মরক্ষার্থে — অন্য কোন কারণে নয়। অনেক সময় দেখবে ঘটনা ঘটেছে—কোন ঘরে হয়তো একলা শিশু ঘুমাচ্ছে, ঐ ঘরেই দীর্ঘক্ষণ ধরে একটা বিষধর সাপ রয়েছে, ঘুরে বেড়িয়েছে, হয়তো তার গায়ের উপর দিয়েও গেছে কিন্তু শিশুটাকে কিছু করেনি। আবার এমন শোনা যায় যে, কোন দামাল শিশু হয়তো খেলাচ্ছলে একটা বিষধর সাপকে ধরতে গেছে বা ধরে ফেলেছে, তাও সাপ তাকে কিছু করেনি। অনেক সময় এও শোনা যায়—ঘুমন্ত অবস্থায় গায়ে পা পড়েছে কিংবা হাত লেগেছে, তখন সাপে কামড়ে দিয়েছে। তাহলে এই সিদ্ধান্তে আসা গেল যে, সাপ হিংস্র নয়, আকস্মিক আঘাতে বা ভয় পেয়ে আত্মরক্ষার জন্য ওরা কামড়ায়—যেটা প্রকৃতিগতভাবেই করে থাকে।

আর একটা বিষয়ে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ—এমনিতেই সাপ ভালো দেখতে পায় না, তবে ওদের গন্ধ তন্মাত্রা প্রবল আর জিভের সাহায্যে সামনেকার জন্তুর vibration টের পায়। দেখবে বেদেরা যখন সাপখেলা করে তখন ওদের হাতের মুঠো অথবা হাতে ধরা হুঁকোর খোলের মতো জিনিসটা যেই উদ্যত-ফণা সাপের কাছে নিয়ে আসে, অমনি সাপটা ছোবল মারে। কাজেই দেখতে না পেলেও ওরা লক্ষ্যবস্তুকে নিখুঁত যাচাই করতে পারে।

যাইহোক বর্ধমান জেলার কয়েকটি অঞ্চলে ঝঙ্কেশ্বরীদেবী আছে যা মনসাদেবী বা স্থায়ীভাবে ঝাঁকলাইচণ্ডী নামে খ্যাত। ওখানকার কোন মানুষকে নাকি সাপে প্রায় কামড়ায়ই না আর কামড়ালেও তেমন বিষ হয় না। যদিও বেশীরভাগ সাপই বিষধর —গোক্ষুরা প্রজাতির সাপ। এই নিয়ে কয়েকবছর আগে সর্পবিজ্ঞানীরা খুব গবেষণাও করেছিল, তখন খবরের কাগজে প্রায়ই এই নিয়ে বেরোত। কিন্তু ফল কি হল তা আর তেমন খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়নি। আমাকে অনেকে এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল—ব্যাপারটা কি ? ব্যাপারটা হচ্ছে—প্রাচীনকালে তোমরা তপোবনের যে চিত্র পাও, সেখানে দেখা যায় যে, সিংহশিশু এবং হরিণশিশু একত্রে সহাবস্থান করছে। সিংহী শিকারে যাবার সময় বা বিপদ বুঝলে শাবকদের কোন মুনির তপোবনে রেখেও যেত, ভাবো একবার ব্যাপারটা ! কিন্তু এর পিছনে বিজ্ঞানটা কি—না প্রেম। ঐ যে মুনি বা ঋষির তপোবন, ওখানে কখনই কোন হিংসাকার্য হয়নি ও হয় না, কারণ ঐস্থানে বসবাসকারীদের মন থেকে হিংসা দূরীভূত হয়েছে। পশু-পাখীরা vibration-এ এটা ধরতে পারে। কোন মানুষেরও মন থেকে সম্পূর্ণভাবে হিংসা দূরীভূত হলে অতি বড় পাষণ্ডও তার কাছে বশ হয়ে যাবে। ভগবান বুদ্ধ নরঘাতক অঙ্গুরীমালকে তো একটা অস্ত্রেই বশ করেছিলেন। নিত্যানন্দের ছেলে বীরচন্দ্র বনের বাঘকে দীক্ষা পর্যন্ত দিয়েছিলেন—এরকম কত নিদর্শন রয়েছে। ভগবান বুদ্ধ একবার বলেছিলেন পৃথিবী থেকে যেদিন সমস্ত কসাইখানা বন্ধ হয়ে যাবে, সেদিন থেকে পৃথিবীতে আর হানাহানি, মারামারি হবে না। কিন্তু আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে দেওয়া ওই মহামানবের ফর্মুলা আজও কি সমাজ মানতে পেরেছে ? ফলে হিংসা বন্ধ হয়নি—মানুষ অহরহ মৃত্যুভয়ে ভীত। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’—স্লোগান তুলছে, কিন্তু তারাই আবার কার্যত হিংসাকেই আশ্রয় করছে—না হয় হিংসাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।

যাইহোক যা বলছিলাম, যে সমস্ত এলাকায় ঝাঁকলাইদেবী রয়েছে—সেখানকার মানুষ পুরুষানুক্রমে কখনই সাপকে আঘাত করে না, মেরে ফেলা তো দূরের কথা ! ফলে সাপেদেরও মানুষ সম্বন্ধে আর কোন ভীতি কাজ করে না। এইজন্যই এই সুন্দর সহাবস্থান। এবার কোন কারণবশত সাপ যদি কাউকে কামড়েও ফেলে, তাহলে দেখা গেছে যে, লোকটির তেমন কিছু বিষ হচ্ছে না। হয়তো সামান্য ঘা হল তাছাড়া আর কিছু নয়। এখানে ব্যাপারটা কি হচ্ছে দেখো —সাপ তার স্বভাববশত হয়তো কাউকে কামড়াচ্ছে কিন্তু পরক্ষণে যেন নিজেই লজ্জিত হয়ে ছেড়ে দিচ্ছে অর্থাৎ তার মধ্যে ক্রোধজনিত কামড়ানো ব্যাপারটা আসছে না। ফলে বিষগ্রন্থি থেকে খুব বেশী পরিমাণ বিষ নিঃসরণ হচ্ছে না। শুধু হয়তো দাঁতটা ভিতরে বসে যাবার জন্য ঘা বা ফোড়া হয়ে তা বেরিয়ে যাচ্ছে।

অনেকে আলকেউটে সাপকে বলে হিংস্র, এরা নাকি তাড়া করে কামড়ায়—একথাও ঠিক নয়। কারণ আমি দীর্ঘকাল মাঠে- ঘাটে-পথে-প্রান্তরে ঘুরেছি, রাত কাটিয়েছি খোলা আকাশের নীচে, প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে নিবিড়ভাবে দেখেছি। ফলে এইসব ব্যাপারগুলোতে নিজস্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি দেখেছি এই সাপগুলো বর্ষার প্রারম্ভে ডিম পাড়ে, ফলে এইসময় যে আলে ওরা বাস করে, সেদিকে কেউ গেলে হয়তো ফোঁসফোঁস করতে করতে কিছুটা এগিয়ে আসে। অথবা হয়তো অন্যত্র খাবারের খোঁজে গিয়েছিল, মানুষের পায়ের শব্দে দ্রুত তার বাসার দিকে আসতে থাকে, এটাকেই মানুষ ‘কেউটে সাপে তাড়া করে’ বলে চালিয়ে দেয়। ঘটনা কিন্তু আদৌ সত্য নয়। আর ডিম বা বাচ্ছা রক্ষা করার প্রবণতা সর্বজীবের রয়েছে—এটা প্রকৃতিগত। কারণ জীবের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বাঁচা এবং বংশবৃদ্ধি। আমি জঙ্গলে হরিণ-মা বা ছাগল-মাকেও তার বাচ্ছাকে রক্ষার জন্য চিতার সঙ্গে অসম যুদ্ধ করতে দেখেছি—যার পরিণতিতে বাচ্ছা হয়তো রক্ষা পেয়েছে কিন্তু মা আত্মবলিদান দিয়েছে। হাঁস, মুরগী, গরু, মোষ সবাই দেখবে এটা করে, তাহলে শুধু শুধু সাপকে দোষ দেওয়া কেন ?